দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

১২ মে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস আজ

মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে কেউ একটি প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন গোটা মানবজাতিকে রক্ষা করল।’ (সুরা আল-মায়েদা, আয়াত ৩২)

9

আজ ১২ মে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস (আইসিএন) ১৯৬৫ সাল থেকে ‘নার্সিং একটি পেশা নয় সেবা’ এই স্লোগান সামনে নিয়ে দিনটি উদযাপন করা শুরু করেছিল। আর সেবা এক মহৎ ধর্ম, জীবন রক্ষা—সবচেয়ে বড় ইবাদত। যখন কোনো ক্লান্ত, জর্জরিত, যন্ত্রণাকাতর মানুষকে স্নিগ্ধ হাতে পানি পান করানো হয়; যখন জ্বরাক্রান্ত শরীরে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, রোগীর বেদনাহত চোখের পাতায় ভরসার হাত রাখা হয়।

তখন এটি কেবল একটি পেশাগত দায়িত্ব নয়, অফুরন্ত সওয়াবের পথও তৈরি করে দেয়।
ইসলাম এমন জীবনঘনিষ্ঠ সেবাকেই দিয়েছে সর্বোচ্চ মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্বের আসন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে কেউ একটি প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন গোটা মানবজাতিকে রক্ষা করল।’ (সুরা আল-মায়েদা, আয়াত ৩২)

এ আয়াতে জীবনের পবিত্রতা ও গুরুত্ব কত গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা খুব সহজেই অনুধাবনযোগ্য।

চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক বা স্বাস্থ্য সহকারী—তিনি যখনই কোনো ব্যক্তির আরোগ্যের পথে এগিয়ে যেতে সহযোগী হন, তখনই তিনি এই আয়াতের অন্তর্গত মর্যাদার হকদার হন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও ছিলেন মানবতার শ্রেষ্ঠ সেবক। তিনি মক্কা-মদিনার অভাবগ্রস্ত, অসুস্থ, অক্ষম মানুষদের কাছে যেতেন, তাদের হাল জানতে চাইতেন। রোগী দেখতে যাওয়া ছিল তাঁর অনুপম সুন্নাহ।

হাদিসে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোগী বা ভাইয়ের সাক্ষাৎ লাভের জন্য যায়, সে জান্নাতের বাগানে প্রবেশ করে যতক্ষণ না সে ফিরে আসে।’
(মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৮)

সাহাবাদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে এ অনুশীলনের চর্চা ছিল। নারী সাহাবি রুফাইদা আল-আসলামিয়্যা (রা.)-কে ইতিহাসের প্রথম নারী নার্স হিসেবে গণ্য করা হয়। মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, খন্দকের যুদ্ধের দিন সাআদ (রা.)-এর চোখ আঘাতপ্রাপ্ত হলে এবং তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে রুফাইদা নামক এক মহিলার কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো। তিনি আহতের চিকিৎসা করতেন।

নবী (সা.) সকাল-সন্ধ্যায় সাআদ (রা.)-এর কাছ দিয়ে যেতে জিজ্ঞাসা করতেন, তোমার দিন কেমন কাটল, তোমার রাত কেমন কাটল? তিনি তাঁকে (নিজ অবস্থা) অবহিত করতেন। (আদবুল মুফরাদ, হাদিস : ১১৩৯)
তা ছাড়া খাইবার যুদ্ধে আহত মুসলিম মুজাহিদদের সুস্থ করতে তিনি মাতৃত্বের মমতাময়ী হাত বাড়িয়ে দেন।

তাঁর এই অবিস্মরণীয় ত্যাগ এবং সেবা-শুশ্রূষার স্বীকৃতিস্বরূপ রাসুল (সা.) পুরুষ মুজাহিদদের সঙ্গে তাঁকেও গণিমতের মালের অংশ দিয়েছিলেন। আজকের বিশ্বেও তিনি নারী চিকিৎসক ও নার্সদের আইডল হয়ে আছেন।

এ ছাড়া নবী (সা.)-এর যুগে যেসব নারী নার্সিং ও সেবাদানে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে হজরত উম্মে আতিয়াহ আল আনসারি (রা.) অন্যতম। মহীয়সী এই নারী রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি সেখানে যুদ্ধাহত সাহাবায়ে কেরামদের সেবা করতেন। অর্থাৎ নার্সের দায়িত্ব পালন করতেন। সে সময়ের ঘটনা তিনি নিজেই বর্ণনা করে বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমি তাঁদের সাওয়ারি ও মালপত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পশ্চাতে থাকতাম, তাঁদের খাবার তৈরি করতাম, আহতদের চিকিৎসা করতাম এবং রোগীদের দেখাশোনা করতাম।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮৫৬)

ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আরেক নার্সিং সাহাবির নাম উম্মে সুলাইম (রা.)। যুদ্ধাহত সাহাবায়ে কেরামকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তিনি ওহুদ, খায়বার ও হুনাইন ছাড়াও উম্মে সুলাইম (রা.) অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মশক ভরে পানি আনতেন। আহতদের পানি পান করাতেন, ছাতু গুলিয়ে দিতেন, তীর উঠিয়ে দিতেন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসার সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করতেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মে সুলাইমকে এবং কিছুসংখ্যক আনসার মহিলাকে যুদ্ধে নিয়ে যেতেন। তাঁরা মুজাহিদদের পানি সরবরাহ করতেন এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৫৩১)

সুতরাং এ কথা অবলীলায় বলা যায়, স্বাস্থ্যসেবার পেশা একটি সম্মানজনক জিহাদ, যা রক্তপাত নয়, বরং প্রাণরক্ষা ও আরোগ্যের পথে উৎসর্গিত। ইসলামে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য এ কল্যাণকর কাজে অংশগ্রহণের অনুমতি রয়েছে। চিকিৎসা ও সেবাক্ষেত্রে নারী সাহাবিয়াদের ভূমিকা প্রমাণ করে—এই পেশা কেবল বৈধ নয়, বরং উৎসাহব্যঞ্জকও বটে।

বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ও ইসলামী মনীষী ইমাম আল-গাজ্জালী (রহ.) তাঁর ‘এহইয়াউ উলুমিদ্দীন’ গ্রন্থে চিকিৎসাকে ফরজে কিফায়া বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন রোগ বাড়ে, তখন চিকিৎসা করা ফরজে কিফায়া হয়ে যায়। সমাজে যদি কেউ চিকিৎসা না করে, তাহলে সবাই গোনাহগার হবে।’ এই উপলব্ধিই প্রমাণ করে, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা কেবল পেশাজীবী নন—তাঁরা জাতির রক্ষক, ইসলামের দৃষ্টিতে পূর্ণ মর্যাদায় ভূষিত।

স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত প্রতিটি হাত- হোক সেটি নার্সের স্নেহস্পর্শ বা চিকিৎসকের প্রজ্ঞাবান পরামর্শ—সবই ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদতের মর্যাদা পায়। তাই নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকলে তাদের প্রতিটি সেবা হয়ে ওঠে ইবাদত, প্রতিটি রাতজাগা হয়ে ওঠে সাওয়াবের পাহাড়। ইমাম ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন, ‘রোগীর সেবা, খাদ্য সরবরাহ, শুশ্রূষা—এগুলো আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয় কাজ।’ (আল-মুগনি, খণ্ড : ৫)

স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য এই দিবস এক আত্মসমালোচনার সুযোগও বটে—আমার সেবা কি কেবল বেতননির্ভর? নাকি এর পেছনে আছে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানুষের কল্যাণের নিয়ত? যদি নিয়ত বিশুদ্ধ হয়, তবে প্রতিটি ইনজেকশন, প্রতিটি ভরসার হাত, প্রতিটি হাসিমাখা সান্ত্বনার বাক্যই হয়ে উঠতে পারে জান্নাতের সোপান।

মানবতার এই সেবকরা আলোর বাহক, যাঁরা অসুস্থতার অন্ধকারে আশার দীপ্তি জ্বালান। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং একটি ধর্মীয় কর্তব্যও। তাই আসুন, আন্তর্জাতিক নার্স দিবসে আমরা তাঁদের সম্মান করি, কৃতজ্ঞতা জানাই, আর দোয়া করি—আল্লাহ যেন এই পেশায় নিয়োজিত সব ভাই-বোনকে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদা দান করেন।

 

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.