দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

সহীহ হাদীস মোতাবেক ‘শবে বরাত’

, আল্লাহর রহমত,ক্ষমা ও সামাজিক সম্প্রীতির রাত

28

ইসলামের বরকতময় রাতগুলোর মধ্যে শবে বরাত এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাত। আরবি ভাষায় একে বলা হয় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’, অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যরাত। শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাত নিয়ে বহু হাদিস ও আলেমদের মতামত পাওয়া যায়, যা ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত নির্দেশ করে। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, এই রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি দেন এবং তাদের ক্ষমা করেন, অসীম দয়া ও করুণায় বান্দাদের ক্ষমা করেন, তাদের রিজিক নির্ধারণ এবং তাকদির লিপিবদ্ধ করেন। তবে মুশরিক ও পরস্পর শত্রুতাপূর্ণ মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের জন্য এই ক্ষমা প্রযোজ্য নয়।

এই বিষয়ে হজরত মু’আজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“আল্লাহ তায়ালা শাবানের ১৫ তারিখ রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি দেন এবং সমস্ত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, তবে মুশরিক ও শত্রুতাপূর্ণ মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের ক্ষমা করেন না।” (সহিহ ইবনে হিব্বান)

শাইখ আলবানী (রহ.) এই হাদিসটিকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন এবং এ সম্পর্কিত আরও আটটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। (সিলসিলা আল-আহাদিস আস-সহিহা: ৩/১৩৫-১৩৯)

আরেকটি হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন:
“একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই রাতে এত দীর্ঘ সেজদায় ছিলেন যে আমি ভীত হয়ে গেলাম এবং তাঁর পা স্পর্শ করলাম। তিনি তখন পা নড়ালেন। তারপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শাবানের মধ্যরাতে পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে অবতরণ করেন এবং বানু কালব গোত্রের ভেড়ার পশমের সংখ্যার চেয়েও বেশি লোককে ক্ষমা করে দেন।’” (তিরমিজি, ইবন মাজাহ)

ইমাম বায়হাকি (রহ.) বলেন, এই হাদিসটি মুরসাল কিন্তু গ্রহণযোগ্য।

হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“যখন শাবানের ১৫ তারিখ রাত আসে, তখন সে রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ো এবং দিনের বেলা রোজা রাখো। কেননা সূর্যাস্তের পর থেকে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন: ‘কেউ কি আছে যে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। কেউ কি রিজিক চাইবে? আমি তাকে রিজিক দেব। কেউ কি আছে বিপদগ্রস্ত, যার বিপদ দূর করব?’ এভাবে আল্লাহ তায়ালা ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” (সুনানে ইবনে মাজাহ)

এই হাদিসটি যদিও দুর্বল, তবে মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, ফজিলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিস গ্রহণযোগ্য হয়।

প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত ইবনে তায়মিয়াহ (রহ.) বলেন:
“শাবানের ১৫ তারিখ রাতের ফজিলত সম্পর্কে বহু হাদিস ও বর্ণনা রয়েছে, যা এই রাতের বিশেষ মর্যাদা প্রমাণ করে। বহু সাহাবি ও তাবেয়ি এই রাতে বিশেষ ইবাদত করতেন। তবে কিছু আলেম এই ফজিলত অস্বীকার করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ইসলামি পণ্ডিতের মত অনুযায়ী, এটি একটি বিশেষ রাত, এবং ইমাম আহমদের বক্তব্যও এর পক্ষেই ইঙ্গিত দেয়।” (ইকতিদা আস-সিরাত আল-মুস্তাকিম: ২/১৩৬)

এই রাতের প্রধান আমল হলো ইবাদতে মশগুল থাকা। তবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যে শবে বরাত পালনের এক বিশেষ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অনেক পরিবার ঘরে হালুয়া-রুটি, ফিরনি, সেমাইসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার তৈরি করে। এদিনে মৃত্যুবরণ করা প্রিয় আত্মীয়স্বজনদের কবর জিয়ারত করা, তাদের জন্য দোয়া করা এবং দান-সদকা করার প্রবণতা দেখা যায়।

বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে মসজিদগুলোয় বিশেষ ওয়াজ মাহফিল ও ইবাদতের আয়োজন হয়। এ ছাড়া অনেকে গরিব-দুঃখীদের মাঝে খাবার বিতরণ করেন, যা সামাজিক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শবে বরাতের অন্যতম বার্তা হলো মানুষের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির চর্চা করা। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই এ রাতে আমাদের উচিত একে অপরের প্রতি ক্ষমাশীল হওয়া, পুরনো রাগ-ক্ষোভ ভুলে যাওয়া এবং সম্পর্ক পুনর্গঠন করা।

একটি সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য পারস্পরিক সহমর্মিতা অপরিহার্য। শবে বরাত আমাদের আত্মশুদ্ধির শিক্ষা দেয় এবং প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালনের তাগিদ দেয়। এই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ রাতে আমাদের উচিৎ ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। এই রাতে নফল নামাজ পড়া, কোরআন তিলাওয়াত করা, জিকির ও দোয়া করা উত্তম আমল এবং পরের দিন রোজা রাখা সুন্নত, কারণ নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শাবান মাসে অধিক পরিমাণে রোজা রাখতেন। এছাড়া তওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং নিজেদের গুনাহের জন্য তওবা করা জরুরি। মুসলিম জাতি হিসেবে পরস্পরের শত্রুতা দূর করা – যেহেতু শত্রুতাপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষমা করা হয় না, তাই কারও প্রতি বিদ্বেষ থাকলে তা দূর করা উচিত।

শবে বরাত আসলে একটি আত্মমূল্যায়নের রাত। এ রাতে আমরা আমাদের জীবনের ভুলগুলো বিশ্লেষণ করতে পারি এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো মানুষ হওয়ার সংকল্প নিতে পারি। কেবলমাত্র ইবাদত করলেই যথেষ্ট নয়; বরং আমাদের চিন্তা-চেতনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা জরুরি।

শবে বরাতের রাত আমাদের জন্য এক মহাসুযোগ। এটি ক্ষমা, রহমত ও কল্যাণের রাত, যেখানে আমরা নিজেদের ভুল-ত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে পারি এবং নতুনভাবে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পারি। পাশাপাশি, সমাজে ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার চর্চা করাও এ রাতের অন্যতম শিক্ষা।

শাবানের মধ্যরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ রাত, যার ব্যাপারে হাদিসসমূহে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যদিও কিছু আলেম এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন, তবে অধিকাংশ ইসলামি স্কলারগণ এই রাতকে ইবাদতের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। অতএব, আমাদের উচিত, এই রাতকে ইবাদতের মাধ্যমে কাটানো এবং আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করা।

আসুন, আমরা সবাই এ রাতে নিজেদের আত্মশুদ্ধির জন্য মনোনিবেশ এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে শবে বরাতের মাহাত্ম্য ও ফজিলত সম্পর্কে জানার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.