দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

গাজা হত্যাকান্ড: একবিংশ শতাব্দীর আরেক ‘হলোকস্ট’ – মুছা করিম

22

পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুগে যুগে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা জাতিগত কারণে নিরাপরাধ, নিরস্ত্র মানুষকে অকাতরে হত্যার মাধ্যমে তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসকগণ তাদের হীণ স্বার্থ চরিতার্থ করে এসেছে। ৭১’এ পাক হানাদার বাহিনীর অভিযান ‘অপারেশন সার্চ লাইটে‘ বাঙালী নিধন, আর্মেনীয় গণহত্যা, জাপানের হিরোসিমা নাগাসাকি গণহত্যা, বসনিয়ার মুসলিম গণহত্যা, কম্বোডিয়ার খেমার রুজ কর্তৃক গণহত্যা, রুয়ান্ডার তুতসি গণহত্যা এবং চীন ও রাশিয়ার কমিউনিস্ট আমলে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে সংঘটিত হত্যাকান্ড গুলো বিংশ শতাব্দীর জঘণ্যতম গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

তবে সব থেকে বর্বরোচিত হত্যাকান্ড হলো ‘হলোকস্ট’। এর নামকরণ ও বৈশিষ্ট্যগত কিছু ভিন্নতা ছিল। হলোকস্ট একটি গ্রীক বা ল্যাটিন শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ ‘পোড়ানো’, উৎসর্গ। পরিভাষায় ‘আগুনে ধ্বংস বা আত্মত্যাগ। কিন্তু রুপক অর্থে গণহত্যা। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্থাৎ ১৯৩৯-১৯৪৫ সালের মধ্যে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের ওপর চালানো গণহত্যা। হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি পার্টির পরিচালনায় জার্মান বাহিনী ইউরোপের ইহুদি জনগোষ্টির অর্ধেকের বেশি অংশকে এবং আরো কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বন্দী ও শ্রম শিবিরে নির্বিচার হত্যা করে। আনুমানিক ষাট লক্ষ ইহুদি এবং আরো অনেক সংখ্যালঘু জাতিগোষ্টির মানুষ এতে প্রাণ দেয়।

হিটলারের বাহিনী ইহুদি ছাড়াও সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী, সাম্যবাদী, রোমানী যাযাবর, শ্লাভীয় জনগণ, প্রতিবন্ধী, সমকামী পুরুষ, ভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের মানুষের ওপর এই হত্যাকান্ড পরিচালনা করে। নাৎসিরা এর নাম দিয়েছিল ‘ইহুদি প্রশ্নে চরম উপসংহার’। অত্যাচার ও গণহত্যার এসব ঘটনা বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হয়েছে। জনাকীর্ণ বন্দী শিবিরে রাজনৈতিক ও যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাসের ন্যায় কাজে লাগাতো, যারা পরে অবসন্ন হয়ে রোগ ভোগের পর মারা যেত। জার্মান দখলিকৃত এলাকায় বিরুদ্ধাচরণকারী ও ইহুদিদের গণহারে গুলি করে হত্যা করে।

ইহুদি ও রোমানি জাতিগোষ্টির লোকদের একত্রে জড়ো করে ‘গ্যাটো’ নামে এক ধরনের বস্তিতে রাখে, যা অনেকটা কারাগারের মত। তারপর গ্যাটো থেকে মালবাহী ট্রেনে করে শত শত মাইল দুরের কোন বধ্যশিবিরে নিয়ে যেত। মালবাহী ট্রেনের পরিবহনেই অধিকাংশ মারা পড়ত। যারা বেঁচে থাকতো তাদেরকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারা হত। তৎকালীন জার্মানীর রাষ্ট্রীয় মদদে, স্বৈরতান্ত্রিক সকল শাখা সর্বাত্মকভাবে গণহত্যায় জড়িত ছিল; জার্মানীকে একটি নরঘাতক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। নাৎসি অত্যাচারের সকল ঘটনা আমলে নিলে সর্বমোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে এককোটি দশ লক্ষে।

গাজা গণহত্যা হলো নাৎসি বাহিনীর রচিত সেই বিংশ শতাব্দীর কলঙ্কিত ইতিহাসের আরেক নতুন চিত্ররুপ। হিটলারের জার্মান নাৎসি বাহিনী কর্তৃক ভুক্তভোগী ইহুদিরা একদা যে অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হয়েছিল, গাজা যুদ্ধের মাধ্যমে ইহুদিবাদী ইসরাইল মুসলিম নিধনের মাধ্যমে সেই জিঘাংসা পূরণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল কর্তৃক গাজা উপত্যাকায় ফিলিস্থিনি জনগণের ওপর প্রচলিত, ইচ্ছাকৃত এবং পদ্ধতিগত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। জাতিগত নির্মূল অভিযানের অংশ হিসেবে অবরুদ্ধ অবস্থায় নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচার হত্যাকান্ড, লক্ষ লক্ষ টন বোমা ফেলে সমস্ত অবকাঠামো ধ্বংস, ফিলিস্তিনি জনগণকে ব্যাপকভাবে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যূত করা, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, অবরোধ দিয়ে খাদ্য সংকটে থাকা ক্ষুধার্ত মানুষকে নিরন্তর অনাহারে রাখা, গুরুতর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, জন্মরোধ, যোৗন সহিংসতা, স্বাস্থ্যগত সকল সুবিধা রহিতকরণ, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়স্থান গুলো ধ্বংস।

২০২৫ সালের অক্টোবর নাগাদ গাজা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৭০ হাজার জন নিহত হয়েছে। প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশি। হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ এবং ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে আছে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

নিহতদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক; যাদের মধ্যে অন্তত ৫০% নারী ও শিশু। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত সংঘাতের তুলনায় গাজাতে সাংবাদিক, মানবিক ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি। দুই লক্ষেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে। গাজার শাসক বা ইসরাইলি প্রতিরোধ গোষ্টি হামাসের সংগে ইসরাইলের অস্ত্র বিরতি চুক্তি হওয়ার পরও দখলদার বাহিনী এখনো হামলা অব্যাহত রেখেছে। এখনো গাজার দিকে দিকে রোগ-শোক, মৃত্যু, নিরন্ন মানুষের আহাজারি, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি।

আন্তর্জাতিক আদালতসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, গাজা হত্যাকান্ড এই একবিংশ শতাব্দীতে ফিলিস্তিনের ন্যায় একটি মর্যাদাপূর্ণ, সংগ্রামী ও আত্মরক্ষার প্রয়োজনে গড়ে ওঠা সমরকুশলী জাতিকে পরিকল্পিতভাবে সমূলে নিধন ও বিতাড়নের অভিপ্রায়ে গণহত্যা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.