দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

গণ-অভ্যুত্থানের পর সংস্কারের পথ সহজ নয় বাংলাদেশের

ইকোনোমিস্টের বিশ্লেষণ

51

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, টানা ১৬ বছরের ভূমিকম্পের মতো আতঙ্কজনক একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে দেশের সামনে এখন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

তিনি এ মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা, তার দল আওয়ামী লীগ (যার কার্যক্রম বর্তমানে নিষিদ্ধ) ও তার সরকারের একনায়কতন্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে। ২০২৪ সালের আগস্টে এক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান আরও বলেন, “আমরা যা কিছু হারিয়েছি, তা পুনর্গঠনের চেষ্টা করছি। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা আশাবাদী।” তবে তার এই আশাবাদ বাস্তবায়ন মোটেই সহজ হচ্ছে না।

শেখ হাসিনার পতনের পর তার সরকারের সময়কার দুর্নীতির বিস্তৃত চিত্র সামনে আসতে শুরু করে। একটি শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়েছে, তার শাসনামলে প্রতি বছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার দেশ থেকে পাচার হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ এবং গণহত্যার অভিযোগে একাধিক মামলা চলছে, যদিও তিনি সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন।

দেশের সব রাজনৈতিক দলই এসব অনিয়মের প্রতিকারে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি তুলেছে। তবে বিপ্লবের ৯ মাস পার হলেও এখনো বড় কোনো পরিবর্তন আনা কঠিন হয়ে পড়েছে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ড. ইউনূস বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেন—যার মধ্যে ছিল নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা এবং সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়। এসব কমিশনে দেশের নাগরিক সমাজ ও শিক্ষা খাতের বিশিষ্টজনেরা যুক্ত আছেন। কমিশনগুলোর সুপারিশ বিশ্লেষণের জন্য গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। এ পর্যন্ত তারা ১৬৬টি সুপারিশ গ্রহণ করেছে এবং ৩৫টি রাজনৈতিক দলের মতামতও নেওয়া হয়েছে।

এই কমিশনের মূল কাজ হলো—জুলাই মাসের মধ্যে একটি ‘চার্টার অব কনসেনসাস’ তৈরি করা, যা ভবিষ্যৎ নির্বাচন ও ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর কাঠামো নির্ধারণ করবে।

তবে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা মোটেও সহজ হচ্ছে না। কেউ কেউ মনে করছেন, শিক্ষা কিংবা টেক্সটাইল খাত নিয়ে কোনো কমিশন না হওয়াটা বড় ভুল। সবচেয়ে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে নারী অধিকার বিষয়ক কমিশনের সুপারিশ, যেখানে ইসলামি উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর জেরে কট্টর ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।

তবু সংস্কারপন্থিরা এখনো আশার সুর বজায় রেখেছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রিয়াজ জানান, ইতোমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের স্বাধীন পদ্ধতি চালু হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী ১৫ মে’র পর সংস্কারের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হবে এবং আগস্টের মধ্যে চূড়ান্ত চার্টার প্রকাশ করা সম্ভব হবে।

এই সময়সূচি ঠিকমতো পূরণ হলে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ড. ইউনূস জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন হবে এবং তিনি তাতে প্রার্থী হবেন না।

এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা আনার কিছু অগ্রগতি দেখালেও সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখনো দুর্বল। উপরন্তু, দেশটির ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করেন আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়নি। অন্যদিকে, রাজপথে প্রতিদিনই বিক্ষোভ এখন সাধারণ চিত্র হয়ে উঠেছে।

এই বিক্ষোভগুলোর অন্যতম প্রধান দাবি হলো আওয়ামী লীগের বিচার। ১২ মে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে, ফলে তারা আর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তবে দলটির কিছু সমর্থন এখনো সমাজে রয়ে গেছে।

কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ আরাফাত বলেছেন, “আওয়ামী লীগ জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিল। আমরা আমাদের বৈধ অবস্থান ফিরে পেতে লড়াই চালিয়ে যাবো।”

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ক্ষমতার বাইরে থেকেও আওয়ামী লীগ আবারও দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে আপাতত, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রয়েছে।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.