খুলনায় সরকারি ভবনের দখল নিয়ে ধুম্রজাল, ভিক্ষাবৃত্তিতে আশ্রিত বাসিন্দারা
বৃদ্ধাশ্রমের নামে ‘অনুদানের ব্যবসা’
এম সাইফুল ইসলাম: খুলনা নগরীর খানজাহান আলী রোডে (নতুন শ্রমভবনের পাশে) অসহায় ও দুঃস্থ নারীদের জন্য শান্তি সদন নামের বৃদ্ধাশ্রম করা হয় ২০০৯ সালে। এখানে থাকা-খাওয়ার জন্য নিয়মিত চাঁদা আদায় ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুদান গ্রহণ করা হলেও আশ্রিত বাসিন্দারা ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবন যাপন করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত চারকক্ষের সরকারি পরিত্যক্ত শিল্পকলা ভবনটি দখলে নিতেই নামে মাত্র বৃদ্ধাশ্রমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন নারী নেত্রী রশিদা আক্তার ওরফে রসু আক্তার। তিনি প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির দায়িত্ব নিয়েই নিয়মভঙ্গ করে ভবনের একটি কক্ষ মাসিক চুক্তিতে বেসরকারি একটি সংস্থাকে ভাড়া দেন। প্রায় দুই বছর ধরে আদায় করা ভাড়ার টাকাও আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এখানে কাগজে-কলমে পরিচালনা কমিটি গঠন ও সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে এলে আশেপাশের বস্তি থেকে বয়স্ক লোকজন এনে দেখানো হয়। বর্তমানে রশিদা আক্তার বিদেশে অবস্থান করায় এখানকার বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগে রয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় সাত শতক জমির ওপর অবস্থিত পুরানো জরাজীর্ন ভবনটিতে ৫-৬ জন নারী শিশু থাকেন। ভবনের চারদিকের দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। জোয়ারের সময় ভবনের প্রবেশপথে হাঁটুসমান পানি জমে। ওই পানি মাড়িয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। এলোমেলো নোংরা পরিবেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে খাট, ব্যবহার্য কাপড়-চোপড়, থালা বাসন। অস্বাস্থ্যকর ভবনটিতে নেই খাদ্য, সুপেয় পানি, চিকিৎসা, বস্ত্রসহ জীবন ধারনের ন্যুনতম কোন সুবিধা।
এখানকার বাসিন্দা ৬০ বছরের বৃদ্ধা মরিয়ম বেগম জানান, আমার ঘর নাই, বাড়ি নাই। ছেলে-মেয়ে নাই, টাকা-পয়সাও নাই। এখানে থাকছি কিন্তু কোন খাওয়া ধাওয়া দেয় না। আমার মেয়েও এখানে থাকে। সে বাসাবাড়িতে কাজ করে। যা পায় তাই দিয়ে চলে কোন রকমে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন নারী জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। জামাই বাড়ি বোঝা হবো না বলে এখানে থাকছি। নামে বৃদ্ধাশ্রম হলেও ভরন-পোষনের সব ব্যবস্থা নিজেরই করতে হয়। খুবই অসহায় অবস্থায় দিন কাটছে।
জানা যায়, দু:স্থ অসহায় নারীদের প্রতি মমতাবোধ থেকে খুলনার কয়েকজন নারী নেত্রী ২০০৯ সালে শান্তি সদন নামে বৃদ্ধাশ্রম তৈরির উদ্যোগ নেয়। রসু আক্তার, কাজী মনোয়ারা বেগম ও ইসরাত আরা হিরাসহ কয়েকজন নারী নেত্রী খুলনা জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে জমি ও শিল্পকলা একাডেমি থেকে ভবন ব্যবহারের অনুমতি নেয়। মহিলা অধিদপ্তর থেকে নেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন। কিন্তু শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে নানা বিতর্ক তৈরি হয়। প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি কাজী মনোয়ারা বেগমের মৃত্যুর পর ইসরাত আরা হিরা প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়মের প্রতিবাদ জানিয়ে পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরে দাঁড়ান। সেই থেকে রসু আক্তার একাই ভবন জমি দখলে রেখে চাঁদা আদায় ও অনুদান গ্রহণ করছেন। কিন্তু যাদের জন্য এতসব আয়োজন সেই বাসিন্দারাই রয়ে গেছেন উপেক্ষিত।
স্থানীয় বাসিন্দা আলী আকবার জানান, অনুদান বানিজ্যের জন্যই দরিদ্র এইসব নারীদেরকে এখানে রাখা হয়েছে। তাদের দেখিয়ে চাঁদা আদায় ও অনুদান আনা হলেও ভূক্তভোগীরা সেইসব সুবিধা পায় না। তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে এখানে থাকা এক নারীকে রসু আক্তার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে এলে আশেপাশের বস্তি থেকে নারীদের এনে এখানে দেখানো হয়। স্থানীয়রা প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে অনিয়মের তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি জানান। রসু আক্তার বিদেশে অবস্থান করায় ও তার কমিটির কোন সদস্যের তথ্য না পাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।