দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার বার্তা দেয় সরিষা ফুল

সবুজ গালিচায় হলুদে মখমলের নকশা

88

খুলনা: শীতকাল এলে বাংলার প্রকৃতিতে যে সৌন্দর্য নতুন রূপে ধরা দেয়, তার মধ্যে সরিষার ক্ষেত এক বিশেষ স্থান দখল করে। হলুদ ফুলে ভরা এই ক্ষেতের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের হৃদয় জয় করে। সরিষার ক্ষেতের পাশ দিয়ে হাঁটলে মনে হয় যেন সবুজের গালিচার ওপর হলুদ রঙের মখমলের নকশা আঁকা হয়েছে। মৌমাছির গুঞ্জন, মৃদু শীতল হাওয়া, আর সরিষার ফুলের সুবাস—সব মিলিয়ে এই দৃশ্য যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়।

সরিষার ক্ষেত শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, কৃষি অর্থনীতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খুলনা কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলের অধিভূক্ত ৪টি জেলায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে রবি মৌসুমে সরিষার (উফশী ও স্থানীয় জাতের) আবাদের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৪১৯ হেক্টর জমি। যার মধ্যে খুলনার লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ৩৩৯ হেক্টর, বাগেরহাট ১ হাজার ৬৮২ হেক্টর, সাতক্ষীরা ১৯ হাজার ৫০ হেক্টর ও নড়াইল জেলায় ১৩ হাজার ৩৪৮ হেক্টর জমি। সর্বশেষ তথ্যনুসারে খুলনাঞ্চলে সরিষার আবাদের অগ্রগতি হয়েছে ৩৪ হাজার ৯৬ হেক্টর জমিতে। একই সাথে এই অঞ্চলে দূর্যোগ সহনশীল (জলাবদ্ধতা সহনশীল) বিনা সরিষা- ৯ জাতের সরিষা ২’শ হেক্টর জমিতে রিলে ফসল চাষ করা হয়েছে।

সরিষার ক্ষেত বাঙালি জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বহুদিন ধরে। শীতের সময় গ্রামের পথের ধারে কিংবা খোলা মাঠে হলুদ সরিষার ক্ষেত যেন বাঙালির ঐতিহ্যেরই প্রতিচ্ছবি। শিশু থেকে বয়স্ক সবাই শীতের সকালে এই খেতের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ভালোবাসে। পিকনিকের জন্যও সরিষার ক্ষেতের আশপাশের অঞ্চলগুলো হয়ে ওঠে আদর্শ স্থান।

সরিষার ফুল কেবল মানুষকে আনন্দ দেয় না, এটি পরিবেশের জন্যও খুবই উপকারী। সরিষার ফুলের মধু সংগ্রহ করতে মৌমাছিরা আসে দূর-দূরান্ত থেকে। এই মৌমাছিরা পরিবেশের পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এই বছর খুলনার কৃষকরা সরিষার আবাদ নিয়ে বেশ আশাবাদী। তাদের মতে, সময়মতো বীজ বপন, সঠিক পরিচর্যা এবং অনুকূল আবহাওয়ার কারণে সরিষার ফলন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খুলনা নগরীর স্থানীয় কৃষক আব্দুল মজিদ জানান, “সরিষার দাম যদি ভালো পাই, তাহলে এবার আমাদের অনেক লাভ হবে। গত বছর আবহাওয়ার কিছুটা প্রতিকূলতার কারণে আমরা প্রত্যাশিত ফলন পাইনি। কিন্তু এ বছর সব ঠিক থাকলে ফলন ভালো হবে বলে আশা করছি।”

খুলনা মেট্রোপলিটন (লবনচরা) কৃষি কর্মকর্তা ফরহদিবা শামস্ জানান, সরিষার ক্ষেতের সৌন্দর্য যেমন সবাইকে মুগ্ধ করে, তেমনি এর অর্থনৈতিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকদের জন্য এটি লাভজনক ফসল হতে পারে, যদি সঠিকভাবে বাজারজাত করা যায়। সরকার এবং স্থানীয় কৃষি বিভাগের উদ্যোগে সরিষা চাষিদের প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান করা হলে সরিষা উৎপাদনে আরও উন্নতি সম্ভব।

জেলার ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ইনসাদ ইবনে আমিন জানান, সরিষা কেবল তেল উৎপাদনের জন্য নয়, এর আরও অনেক ব্যবহার রয়েছে। সরিষার খোল, যা তেল উৎপাদনের পর বাকি থাকে, তা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সরিষার খেতে কিছু নির্দিষ্ট ধরনের শাকও পাওয়া যায়, যা খাবারের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই ফসলটি সহজেই উৎপাদনযোগ্য এবং এর পরিচর্যার খরচও তুলনামূলক কম।

খুলনা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিনিয়র মনিটরিং কর্মকর্তা (পার্টনার প্রকল্প) কৃষিবীদ মো. মোছাদ্দেক হোসেন জানান, সরিষার তেল পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং এটি আমাদের রান্নার অপরিহার্য উপাদান। এটি ত্বক এবং চুলের যত্নেও ব্যবহৃত হয়। গ্রামীণ বাংলায় শীতের সকালে সরিষার তেল দিয়ে মালিশ করার ঐতিহ্য এখনো অনেক জায়গায় প্রচলিত।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপ-পরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর আলম জানান, সরিষার চাষে কৃষকরা কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। রোগ-বালাই, কীটপতঙ্গ, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সবকিছুই সরিষার ফলনে প্রভাব ফেলে। এছাড়া বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাবও কৃষকদের জন্য সমস্যা তৈরি করে। আমরা এসব বিষয় মাথায় রেখে কাজ করছি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.