দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

গণতন্ত্রের উন্নয়নে PR নির্বাচন পদ্ধতির অবদান ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

96

Proportional Representation (PR) হলো একটি নির্বাচন ব্যবস্থা, যেখানে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন পায়। এই পদ্ধতিতে জনগণের দেওয়া ভোটের পরিমাণ অনুযায়ী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়, ফলে জনমতের বেশি সঠিক ও ন্যায্য প্রতিফলন ঘটে।

PR নির্বাচন পদ্ধতির ধারণা উনবিংশ শতাব্দীতে (19th century) গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ গণিতবিদ Thomas Hare এবং ফরাসি চিন্তাবিদ Victor D’Hondt এই পদ্ধতির উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত। ১৮৮০-এর দশকে সুইজারল্যান্ডে প্রথমবার PR নিয়ে আলোচনা এবং সীমিত প্রয়োগ হয়। এরপর ১৮৫৫ সালে ডেনমার্কে এটি প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে ব্যবহার হয় এবং ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে PR ব্যবস্থার আইনগতভাবে আনুষ্ঠানিক প্রবর্তন ঘটে। পরবর্তীতে এটি ইউরোপজুড়ে এবং বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে পৃথিবীতে ১৯৫টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্র রয়েছে, যার মধ্যে ১৯৩টি জাতিসংঘের সদস্য এবং ২টি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র—ভ্যাটিকান সিটি ও ফিলিস্তিন। জাতিসংঘের এই ১৯৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় ১৬৫–১৭০টি দেশে কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করা হয়। এর মধ্যে আনুমানিক ২০–২৫টি রাষ্ট্র সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক, যেখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়; যেমন নরওয়ে, সুইডেন, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড।

 

প্রায় ৮৫–৯০টি দেশ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও দুর্বল প্রতিষ্ঠান, সীমিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদ্যমান; উদাহরণস্বরূপ ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ব্রাজিল। প্রায় ৩০–৪০টি দেশ হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা অনুসরণ করে, যেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তা অনেকাংশেই প্রহসনের মতো এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বিদ্যমান থাকে; যেমন রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা ও তুরস্ক। অপরদিকে, প্রায় ২০–২৫টি দেশ একদলীয় শাসন বা স্বৈরশাসন অনুসরণ করে, যেখানে নির্বাচন হয় না বা হলেও তা অগণতান্ত্রিক, নিয়ন্ত্রিত ও প্রতীকী মাত্র; উদাহরণ উত্তর কোরিয়া, সৌদি আরব, ইরান ও চীন। যে ১৬৫–১৭০টি দেশে কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে, তার মধ্যে বর্তমানে PR পদ্ধতি প্রায় ৯০–১০০টি দেশের কোনো না কোনো পর্যায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ এটি মূল নির্বাচনী ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহার করছে, যা এটিকে বিশ্বব্যাপী একটি প্রতিষ্ঠিত এবং জনপ্রিয় পদ্ধতিতে পরিণত করেছে। PR পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—এটি জনগণের ভোটের সঙ্গে প্রতিনিধিত্বের একটি সরাসরি ও ন্যায্য সম্পর্ক স্থাপন করে। এই পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী যে পরিমাণ ভোট পায়, সে অনুপাতে তারা আসন লাভ করে, ফলে জনগণের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলন ঘটে সংসদে। এতে করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, মত, সংখ্যালঘু ও ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়, যা গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলে।

 

PR পদ্ধতিতে একক দলীয় আধিপত্য কমে আসে এবং কোয়ালিশন সরকার গঠনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরামর্শ ও সমঝোতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এটি রাজনৈতিক মতভেদ ও বিভাজন হ্রাস করে এবং একাধিক কণ্ঠকে গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ দেয়। বিশেষ করে নারীর অংশগ্রহণ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে PR পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এছাড়া ভোটারদের ভোট নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে, কারণ প্রায় প্রতিটি ভোটই প্রতিনিধিত্বে পরিণত হওয়ার সুযোগ পায়। ফলে ভোটারদের মধ্যে রাজনৈতিক আগ্রহ, অংশগ্রহণ এবং সরকারের প্রতি আস্থা বাড়ে।

 

এই পদ্ধতি বহুমতের বিকাশ ঘটায় এবং একচেটিয়া শাসন বা ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধে কার্যকর এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়। বাংলাদেশে PR পদ্ধতির নির্বাচন চালু হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা ও কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতে পারে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—এটি ভোটের প্রতিফলনকে অধিক সঠিক ও ন্যায্য করে তোলে। বর্তমানে প্রচলিত First Past the Post (FPTP) পদ্ধতিতে যে দল সবচেয়ে বেশি ভোট পায়, তারা অধিকাংশ আসন নিয়ে নেয়, ফলে অনেক সময় মোট ভোটের বড় অংশ সংসদে প্রতিনিধিত্ব পায় না। কিন্তু PR পদ্ধতিতে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, তারা তত শতাংশ আসন পাবে, ফলে ছোট রাজনৈতিক দল, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ বাড়বে।

 

এতে একটি বহুমত ও বহুধা মতের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক মেরুকরণ, সহিংসতা ও বিভক্তির প্রেক্ষাপটে PR পদ্ধতি সবার মতামতকে মূল্যায়ন করে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ গঠনে সহায়ক হতে পারে। তবে এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। যেমন, এই পদ্ধতিতে কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রবণতা বাড়ে, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া ভোট ও নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রশাসনিক দুর্বলতা, স্বচ্ছতার ঘাটতি ও দলীয় প্রভাব থাকায় PR পদ্ধতির সফল বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হতে পারে। ভোটারদের মধ্যে এই পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা কম থাকায় বিভ্রান্তিও সৃষ্টি হতে পারে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে PR পদ্ধতিও ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। বাংলাদেশে অনেক বড় রাজনৈতিক দল PR পদ্ধতির বিরোধিতা করে থাকে।

 

এর কারণ হলো, বর্তমানে প্রচলিত FPTP পদ্ধতি বড় দলগুলোর জন্য সুবিধাজনক, কারণ এতে তারা সামান্য ভোটে একটি আসন জিতে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় অবস্থান নিশ্চিত করে। কিন্তু PR পদ্ধতিতে ছোট দল ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ায়, যা বড় দলগুলোর ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেয় এবং তাদের আসন সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়া PR পদ্ধতি কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা বাড়ায়, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় বাধা দিতে পারে বলে বড় দলগুলো উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলগুলোর মধ্যে আস্থা কম থাকায় একাধিক দলকে সমান অংশগ্রহণ দেওয়া বড় দলগুলোর জন্য অস্বস্তিকর। ভোট ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ থাকার কারণে তারা বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তনে অনাগ্রহী। ফলে বড় দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা ও নিয়ন্ত্রণ রক্ষায় PR পদ্ধতির বিরোধিতা করে থাকে।

 

গণতন্ত্রের উন্নয়নে Proportional Representation (PR) নির্বাচন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, যা ভোটারদের মতামতকে সংসদে সঠিক ও ন্যায্যভাবে প্রতিফলিত করতে সহায়তা করে। PR পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন পায়, ফলে ছোট দল, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ও নারীসহ সকলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। এটি একক দলীয় আধিপত্য কমিয়ে সমন্বিত ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শক্তিশালী করে। তবে বাংলাদেশে PR পদ্ধতির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির মেরুকরণ, দলীয় দম্ভ ও আস্থার অভাব, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা সংকট এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা এই পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তদুপরি, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থের কারণে PR পদ্ধতির গ্রহণে অনীহা থাকায় এর সফল বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ভোটারদের মধ্যে এই পদ্ধতির ব্যাপারে সচেতনতার অভাবও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এসব সত্ত্বেও, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনি সংস্কার ও শিক্ষামূলক প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে PR পদ্ধতি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

 

সাধারণ জনসাধারণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি হলো এমন ব্যবস্থা যা ভোটের শক্তি সর্বোচ্চ রক্ষা করে, প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে। এই দিক থেকে PR পদ্ধতি বিশেষভাবে কার্যকর, কারণ এতে ভোটের অনুপাতে আসন বরাদ্দ হয়, ফলে ছোট দল, সংখ্যালঘু ও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ে এবং ভোটারদের ভোট ‘নষ্ট’ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তবে বাংলাদেশে বাস্তবতা বিবেচনায় মিশ্র পদ্ধতি (Mixed Electoral System), যেখানে কিছু আসন সরাসরি (First-Past-The-Post) ও কিছু PR পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, অধিক কার্যকর হতে পারে। এটি বৃহৎ দলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি সংখ্যালঘু ও বিভিন্ন মতের অংশগ্রহণ বাড়ায়। তাই সাধারণ জনগণের স্বার্থে এমন নির্বাচন পদ্ধতি থাকা উচিত যা স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায্য, যাতে ভোটের মূল্য বাড়ে এবং দেশের গণতন্ত্র আরও সুদৃঢ় হয়।

বাহলুল আলম
(একজন লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক)

Leave A Reply

Your email address will not be published.