দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

গাজায় চলছে আরেক ‘নাকবা’

76

গাজা শহরের বৃহৎ একটি অংশকে আবারো ‘অসুরক্ষিত’ ঘোষণা করেছে ইসরাইল। ইসরাইলি বাহিনী (IDF) জানিয়েছে, তারা ওই এলাকায় তীব্র বিমান হামলা চালাতে চলেছে। এর আগে, ওই অঞ্চল অনেকটাই ধ্বংস হয়েছে অবিরাম বোমাবর্ষণে। এবার ইসরাইল আরও এক ধাপ এগিয়ে সরিয়ে নিতে বলেছে সাধারণ মানুষকে।

লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, আল-শিফা হাসপাতাল এবং তিনটি পুরাতন স্কুল ভবন। ইসরাইলের দাবি, এসব স্থাপনা হামাসের কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন ও সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, সেখানে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এতবড় স্থান খালি করতে সময় লাগবে এবং প্রাণহানি আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারে।

ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট এই সামরিক অভিযানের সম্প্রসারণের বিরোধিতা করেছেন। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “বেশিরভাগ ইসরাইলি ও সেনা কর্মকর্তা এই যুদ্ধের সম্প্রসারণ চান না। যুদ্ধ থামানো উচিত এখনই।”

ওলমার্ট গাজার মানবিক সংকট নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “এই অবস্থাকে ক্ষমা করা যায় না। অবিলম্বে থামাতে হবে। মানুষকে খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”

জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে, অবরুদ্ধ গাজায় ২১ লাখ মানুষের দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ১০ সপ্তাহ ধরে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এখনই ব্যবস্থা না নিলে একটি প্রজন্ম স্থায়ী ক্ষতির শিকার হবে।

ইসরাইলি মুখপাত্র দাবি করেছেন, “গাজায় দুর্ভিক্ষ নেই, খাবার আছে।” তবে হামলার বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। গত ১৮ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পুনরায় বোমাবর্ষণে ইতিমধ্যেই ২,৭৯৯ জন নিহত হয়েছেন।

এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকা একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে। এতে কিছু বন্দিমুক্তি ও অস্থায়ী শান্তির শর্ত রয়েছে। হামাস স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও ইসরাইলি বাহিনীর গাজা ত্যাগ ছাড়া বন্দিমুক্তিতে রাজি নয়।

এদিকে ৬৭ জন সাবেক বন্দি এক খোলা চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি করে সকল বন্দির মুক্তির ব্যবস্থা করেন। তবে শেষমেষও, নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, “যুদ্ধ থামানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না।”

এছাড়া গাজার অভ্যন্তরের বেশ কয়েকটি করিডোর তৈরি শুরু করেছে ইসরাইল। এর মধ্যে অন্যতম মোরাগ করিডোর। অর্থাৎ গাজাকে কয়েকটি এলাকায় অবরুদ্ধ করে ফেলতে চাইছে ইসরাইল। এলাকাটির অধিকাংশ অধিবাসীই এখন বাস্তুহীন। ২০২৩ সালে যিনি লাখপতি ছিলেন, তিনিও এখন খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন। এই অবস্থাকে আরেক নাকবার সাথে তুলনা করেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

নাকবা (Nakba), যার অর্থ ‘বিপর্যয়’ বা ‘মহাবিপর্যয়’, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ভয়াবহ ঐতিহাসিক ঘটনা, যা তাদের জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম বেদনাদায়ক অধ্যায়। এই ঘটনাটি মূলত শুরু হয় ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাবিত “প্যালেস্টাইন বিভাজন পরিকল্পনা” (UN Partition Plan) অনুযায়ী। সেখানে ব্রিটিশ শাসিত প্যালেস্টাইনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—একটি ইহুদিদের জন্য, অন্যটি আরবদের জন্য। যদিও ফিলিস্তিনি আরবরা এবং আরব রাষ্ট্রগুলো এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু ইহুদি নেতারা তা গ্রহণ করে এবং ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।

এর পরদিন, ১৫ মে ১৯৪৮ সালে, আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়, যার পটভূমিতে সংঘটিত হয় “আল-নাকবা”। এই যুদ্ধে ইসরাইলি বাহিনী ও ইহুদি মিলিশিয়ারা সশস্ত্র হামলা চালায় বহু ফিলিস্তিনি গ্রামে। এর ফলে ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি, জমি ও সম্পত্তি হারিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। প্রায় ৫০০-রও বেশি গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, যাতে তারা আর ফিরে যেতে না পারে। বহু জায়গায় গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। যেমন দেইর ইয়াসিন গণহত্যা। এই ঘটনা শুধু শারীরিক বাস্তুচ্যুতি ছিল না, বরং এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও পরিচয়চ্যুতি, যা ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।

নাকবার ফলে গড়ে ওঠে বিশাল শরণার্থী জনগোষ্ঠী, যারা আজও লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, গাজা, পশ্চিম তীর ও অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তারা এখনও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNRWA)-এর সহায়তায় জীবন যাপন করছে এবং তাদের অধিকাংশই নিজ দেশে ফেরার অধিকার থেকে বঞ্চিত। আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবে তাদের “ফিরে যাওয়ার অধিকার” স্বীকৃত হলেও ইসরাইল সেই অধিকার মানে না।

আজও ফিলিস্তিনিরা প্রতি বছর ১৫ মে “নাকবা দিবস” হিসেবে পালন করে, যেদিন তারা তাদের হারানো ভূমি, বাড়ি এবং অধিকারের জন্য শোক ও প্রতিবাদ জানায়। নাকবা শুধু একটি অতীতের ঘটনা নয়, বরং এটি একটি চলমান বাস্তবতা, কারণ ফিলিস্তিনিরা এখনও অবরুদ্ধ, শরণার্থী এবং অধিকারের লড়াইয়ে নিয়োজিত।

৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের আগ্রাসনের জবাবে ইসরাইল সামরিক অভিযান শুরু করে গাজায়। এরপর থেকে গাজায় নিহতের সংখ্যা ৫২,৯০০ ছাড়িয়েছে বলে জানাচ্ছে সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত আহত প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ। এছাড়া প্রথম নাকবার মতোই বর্তমানে ফিলিস্তিনের নাগরিকদের একইভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। গাজার সংস্কৃতি বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। অর্থাৎ একটি জাতিকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে যা যা দরকার, তার সবই করা হচ্ছে ইসরাইলের নিখুঁত প্লানমাফিকভাবে। এটিকে আরেক নাকবা অবশ্যই বলা চলে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.