আসাফুর রহমান কাজল, খুলনা: সুন্দরবন, বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। যা দেশের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত এক অনন্য প্রাকৃতিক রত্ন। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। বছরের নির্দিষ্ট সময়গুলোতে, বিশেষত শীত মৌসুমে, এটি ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে ওঠে। আর এখন মৃদু শীতল হাওয়া প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ ও সুগন্ধিতে ভরিয়ে তুলেছে। ফলে সুন্দরবনের ইকো ট্যুরিজমের রিসোর্টগুলোতে জমে উঠছে ভ্রমণপ্রেমীদের ঢল।
প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন অনেকেরই থাকে। একদম দূরে, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। সেখানে গিয়ে প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই তৈরি হয় ইকো ট্যুরিজমের ধারণা। বাংলাদেশে ইকো ট্যুরিজমের সম্ভাবনা অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। সুন্দরবন এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অমূল্য রত্ন। পরিবেশবান্ধব ভ্রমণের জন্য অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য।
সুন্দরবন কেন্দ্রিক বাড়ছে রাজস্ব
বন বিভাগ জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণে যান ১ লাখ ২৮ হাজার ১৭৫ জন পর্যটক। এর মধ্যে দেশি পর্যটক ছিলেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৪১২ জন এবং বিদেশি ৪ হাজার ৭৬৩ জন। বন বিভাগের রাজস্ব আসে ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেন ২ লাখ ১১ হাজার ৫৭ জন পর্যটক। এর মধ্যে দেশি ২ লাখ ৮ হাজার ৪৩৫ জন এবং বিদেশি ২ হাজার ৬২২ জন। এ থেকে রাজস্ব আসে হয় ৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
সুন্দরবন: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট
সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসেবে পরিচিত। এটি UNESCO বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত এবং এখানকার জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে বাঘ, হরিণ, কুমির এবং অসংখ্য প্রজাতির পাখি, পৃথিবীজুড়ে পরিচিত। সুন্দরবনের বিশালতা, জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিবেশবান্ধব পর্যটনের জন্য এক স্বর্গীয় স্থান।
সুন্দরবন ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হল শীতকাল। বিশেষত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। এই সময়টিতে ঘুরতে যাওয়ার জন্য আদর্শ। কারণ মৃদু শীতল আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৌন্দর্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে আরও চমৎকার করে তোলে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন এবং জলা অঞ্চলগুলো এই সময়ে আরও সুন্দর এবং উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এছাড়া, এই সময়ে বিভিন্ন ধরনের পক্ষী ও প্রাণীর বিচরণও বেড়ে যায়। যা ভ্রমনকারীদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়।
সুন্দরবনে ইকো ট্যুরিজমের সম্ভাবনা
সুন্দরবন ভ্রমণের মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, অন্যদিকে এখানকার পরিবেশ রক্ষার জন্য পর্যটকরা সচেতনভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন। সুন্দরবনের ভেতরে থাকা বিভিন্ন ট্রেইল, জলপথ, পাখির অভয়ারণ্য, বাঘ দেখতে পাওয়া এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ভ্রমণ পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। এসব স্থানে গিয়ে পর্যটকরা শুধু সৌন্দর্যই উপভোগ করেন না, বরং পরিবেশ এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হন।
ইকো ট্যুরিজমের জনপ্রিয়তা
সুন্দরবন কেন্দ্রিক ইকো ট্যুরিজম এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। পরিবেশবান্ধব এই ট্যুরিজমের মাধ্যমে পর্যটকরা বনের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ব হতে পারেন, যাতে তারা অল্প সময়েই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। সুন্দরবনের ইকো রিসোর্টগুলো সাধারণত পরিবেশের ওপর কম প্রভাব ফেলে। কারণ এসব রিসোর্টের নকশা এমনভাবে করা হয় যাতে প্রকৃতির সঙ্গতি বজায় থাকে।
দুর দূরান্তের ভ্রমণপিয়াশুরা এখন সুন্দরবনে ছুটে আসছেন। বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকরাও এখানে আসছেন, কারণ ইকো ট্যুরিজম এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হচ্ছে। পাশাপাশি সুন্দরবনের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে।
ইকো ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন এমন একটি ভ্রমণ প্রক্রিয়া যেখানে প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে সমন্বয় করে ভ্রমণ করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে পরিবেশের ক্ষতি না করে পর্যটন বিকাশ করা। এখানে ভ্রমণকারীরা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেন। তবে তারা প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তাদের কাজের মাধ্যমে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না।
এমনকি ইকো ট্যুরিজমের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার উন্নয়নও সাধিত হচ্ছে। তারা তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষিত রেখে পর্যটনের সুবিধা ভোগ করতে পারেন। এর মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, এবং স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী করা সম্ভব।
রিসোর্ট এবং বিশেষ আকর্ষণ
এই সময়ে সুন্দরবনে বেশ কিছু এক্সক্লুসিভ রিসোর্ট রয়েছে। যেখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে ভ্রমণ করা যায়। রিসোর্টগুলো সাধারণত নদীর তীরে বা জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত, যা পরিবেশের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। এমনকি কিছু রিসোর্টে স্থানীয় নৌকা বা কাঠের নৌকায় ঘুরে বনের প্রাণী ও প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। যা এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা প্রদান করে।
সুন্দরবন সংলগ্ন ইকো কটেজ
সুন্দরবনে পর্যটকদের জন্য এখন নতুন আকর্ষণ ইকো কটেজ ও রিসোর্ট। বনের পাশেই গড়ে উঠেছে এসব কটেজ। পর্যটকরা সেখানে গিয়ে উপভোগ করছেন বনের নৈসর্গিক দৃশ্য। ইতোমধ্য সুন্দরবন লাগোয়া কৈলাশগঞ্জ, ঢাংমারী ও আশপাশের এলাকায় চালু হয়েছে কমপক্ষে ২০টি ইকো রিসোর্ট ও কটেজ। এর মধ্যে জঙ্গলবাড়ি, ইরাবতী, গোলকানন, বনলতা, বনবাস, বনবিবি, বনমালী, বাদাবন, সুন্দরী, শর্মিলা, ম্যানগ্রোভ হ্যাভেন, পিয়ালি, নির্বাসন জঙ্গলভিলা অন্যতম। এ ছাড়া নির্মাণাধীন রয়েছে আরও কয়েকটি।
সুন্দরবনে ভ্রমণের নিরাপত্তা এবং নিয়মাবলী
যেহেতু সুন্দরবন একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, তাই এখানে ভ্রমণ করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট নিয়মাবলী রয়েছে। সরকারি অনুমতি ছাড়া সুন্দরবনে প্রবেশ করা যায় না এবং শুধুমাত্র নিবন্ধিত ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে গাইড এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া যায়। এটি নিশ্চিত করে যে বনাঞ্চল ও এর পরিবেশের কোনও ক্ষতি না হয়। এছাড়াও, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এখানকার জীববৈচিত্র্য এবং বনসংশ্লিষ্ট প্রকৃতির সুরক্ষা বজায় রাখা যায়।
ইকো ট্যুরিজমের মাধ্যমে স্থানীয়দের উন্নয়ন
সুন্দরবনে ইকো ট্যুরিজমের বিকাশে স্থানীয় জনগণের মধ্যে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়। গাইড, হোটেল ব্যবসা, নৌকা চালনা, বাজারজাতকরণ এবং অন্যান্য পর্যটন সেবা পেশায় স্থানীয়রা নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে। এই ধরনের কাজের মাধ্যমে তারা শুধু আয়ের উৎসই সৃষ্টি করে না, বরং পরিবেশ সচেতনতার মাধ্যমে তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।
এছাড়া, সুন্দরবন কেন্দ্রিক ইকো ট্যুরিজমের বিকাশে স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে পরিবেশের গুরুত্ব নিয়ে শিক্ষা দেওয়ারও সুযোগ সৃষ্টি হয়। স্থানীয়রা তাদের প্রতিবেশী বনাঞ্চল এবং জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষায় আরও দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে পারে।
উদ্যোক্তাদের ভাবনা
জঙ্গলবাড়ি ম্যানগ্রোভ রির্সোটের পরিচালক জাকারিয়া হোসাইন শাওন বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশ ইকো ট্যুরিজমের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়। সুন্দরবনের সৌন্দর্য বর্তমানে ইকো ট্যুরিজমক্ষেত্র দেশের পর্যটন সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সুন্দরবনের পাশে ঢাংমারি গ্রামের প্রতিটি রিসোর্টই গড়ে উঠেছে বনভূমির নিকটে এবং এতে ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রী যেমন বাঁশ, কাঠ, গোলপাতা ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব। জঙ্গলবাড়ি ম্যানগ্রোভ রিসোর্ট পানির উপরে নির্মিত, যেখানে থেকে নদী ও বনের দৃশ্য দেখা যায়। এ রিসোর্টে একদিকে অতিথিরা সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন, অন্যদিকে পরিবেশের ক্ষতি না করে জীবনযাপন করতে পারেন।
আমরা জঙ্গলবাড়ি ইকো রিসোর্ট থেকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, প্রকৃতির সান্নিধ্যে বিনোদনের সুযোগ, সংস্কৃতির মিলন, প্রাকৃতিক সম্পদের বৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশদূষণ রোধ, পরিবেশবান্ধব টেকসই পর্যটনের বিকাশ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধনে সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলে ইকো ট্যুরিজমের মাধ্যমে পর্যটনের নব দিগন্ত উুন্মোচন করেছি।
জলবায়ু পরিবর্তনের এ সময়ে ইকো ট্যুরিজমের ধারণা দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, মানব-পরিবেশ মিথস্ত্রিয়া ও প্রকৃতি সংরক্ষণে ইকো ট্যুরিজমের গুরুত্ব অপরিসীম। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে ভুগতে থাকা বাংলাদেশের মতো দেশসমূহের জন্য ইকো ট্যুরিজমের ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ
সুন্দরবন কেন্দ্রিক ইকো ট্যুরিজমে ভবিষ্যতে আরও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এখানে বিভিন্ন ধরণের ইকো ট্যুরিজম প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। বিশেষ করে শীতকালে পাখি দেখার ভ্রমণ, মনোরম নৌভ্রমণ এবং বনভ্রমণকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে বিভিন্ন প্রোগ্রাম শুরু করা যেতে পারে।
তবে এই সম্ভাবনার সাথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশেষ করে অতিরিক্ত পর্যটন এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য পর্যটকদের সচেতনতা এবং পর্যটন ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা, স্থানীয়দের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং পর্যটকদের পরিবেশবান্ধব আচরণ এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সহায়ক হবে।
সুন্দরবন হলো প্রকৃতির এক অমূল্য রত্ন। যার মধ্য দিয়ে ইকো ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয় বরং পৃথিবীর একটি বিশেষ পর্যটন গন্তব্য। পরিবেশবান্ধব ভ্রমণকারীরা সুন্দরবনে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি প্রকৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব নিতে পারেন। সুন্দরবন কেন্দ্রিক ইকো ট্যুরিজমে পর্যটকদের সহায়তা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করে এই প্রকৃতির রত্নটিকে আরও অনেক বছর ধরে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। যাতে আগামী প্রজন্মও এই অমূল্য রত্ন উপভোগ করতে পারে।