দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

সাতক্ষীরায় লবণাক্ততায় হারিয়েছে মাঠ, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কাঁকড়ায়

30

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নদীপাড়ের বাতাসে মৃদু লবণের ঝাঁঝ। কাদামাখা সরু মাটির রাস্তায় পা ডুব দেয় কাদায়, তবু মন ভরে থাকে দৃঢ় আশা ও সাহসে। হাঁটতে হাঁটতে দেখা মিলল রবিউল ইসলামের সঙ্গে। তার গায়ে পুরনো গেঞ্জি, চোখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু কণ্ঠে মিষ্টি আশার সুর ‘মাটি নোনা হয়ে গেছে, ধান আর হয় না। মাছও কমে গেছে। তবু কাঁকড়া চাষের ঘেরেই এখন শ্বাসরুদ্ধ জীবনে একটু শান্তির নিঃশ্বাস পাই।’

রবিউলের ছোট্ট কথাগুলোতে লুকিয়ে ছিল এক নতুন সূর্যোদয়, হারানো দিনের মাঝে জীবনের ফেরার স্বপ্ন। কাঁকড়া চাষের ঘের যেন তার জীবনের নতুন আশ্রয়, যেখানে প্রতিদিন জেগে ওঠে নতুন প্রত্যাশা।

একসময় এই জমিতে ধানের শীষে দুলত হাওয়া, বর্ষায় ফসলের জন্য বুক বেঁধে অপেক্ষা করত কৃষকরা। এখন সেই মাঠ লবণাক্ত পানির দখলে। আইলা, আম্পান ও ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ে নদীর নোনা পানি ঢুকে ভাসিয়ে নিয়েছে ফসলের স্বপ্ন। তবু উপকূলের মানুষ হাল ছাড়েনি। লবণাক্ত মাটিতেই কাঁকড়া চাষ করে তারা লিখছে জীবনের নতুন গল্প।

জলবায়ুর আঘাতে বদলে যাওয়া উপকূলের জীবন: সাতক্ষীরার উপকূল বহু বছর ধরেই জলবায়ুর আঘাত সয়ে যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত এক দশকে জেলার প্রায় ৩০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি লবণাক্ত হয়ে গেছে, যেখানে একসময় ধান, পাট আর সবজিতে ভরপুর ছিল মাঠ।

গাবুরার কৃষক মতিউর রহমান ঘেরপাড়ে বসে বললেন, ‘দুই মৌসুম ধরে এক মুঠো ধানও হয়নি। ঋণ মাথায় চেপে বসেছিল। ভাবছিলাম শহরে গিয়ে দিনমজুরি করব। কিন্তু কাঁকড়ার ঘেরেই এখন বাঁচার ভরসা পাচ্ছি।’

বঙ্গোপসাগরের লোনা পানি নদী পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে মাঠে। গাবুরা, বুড়িগোয়ালীনী, পদ্মপুকুর, কৈখালী—এমন ইউনিয়নের অনেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন শহরে। তবু যারা থেকে গেছেন, তারা হার মানেননি। ঘেরের কাদায় পা ডুবিয়ে, হাত মেখে তারা নতুন জীবন গড়ছেন। প্রতিটি কাঁকড়ার খোলস বদল যেন তাদের জীবনে টিকে থাকার নতুন বার্তা লিখে দিচ্ছে।

 

কাঁকড়া চাষ: লবণাক্ততার মাঝেই সম্ভাবনা একসময় কৃষকের শেষ ভরসা ছিল ধান আর মাছের ঘের। এখন সেই নোনা জমিই নতুন অর্থনীতির ভিত্তি। এক দশক আগে সাতক্ষীরায় কাঁকড়া চাষ সীমাবদ্ধ ছিল মাত্র ৫০ হেক্টরে, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৪ হেক্টর জমিতে। গড়ে উঠেছে ৩৬৫টি খামার আর দুই হাজারের বেশি ঘের। জেলার এই খামারগুলোতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। জেলা মৎস্য অফিসের হিসাবে, প্রতি বছর কাঁকড়া রপ্তানি থেকে আসে প্রায় ৮ লাখ ২২ হাজার মার্কিন ডলার বৈদেশিক আয়।

শ্যামনগরের কলাগাছি গ্রামের কাঁকড়া চাষী জালাল হোসেন কাদামাখা খাঁচা হাতে নিয়ে বললেন, ‘২০১৬ সালে ছোট পরিসরে শুরু করেছিলাম। তখন ৫০–১৫০ টাকায় পোনা কিনতাম। এখন বিশ্ববাজারে চাহিদা বেড়েছে, তাই ২০০–৩০০ টাকায় রেনু কিনতে হয়। কিন্তু দাম ভালো—৬০০ থেকে ১১০০ টাকায় বিক্রি করতে পারছি। ধান করলে কখনো এত আয় হতো না।’
সুন্দরবনসংলগ্ন নদীগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে রেনু থেকে বড় হওয়া কাঁকড়া সহজেই ধরা যায়। আর এ অঞ্চলে ১২ মাস লোনা পানি থাকায় কাঁকড়া চাষের জন্য এটি বিশেষভাবে উপযোগী। ঘেরপাড়ে কাদায় পা ডুবিয়ে চাষিরা এখন স্বপ্ন গোনেন—প্রতিটি কাঁকড়ার খোলস পাল্টানো যেন নতুন টাকার অঙ্ক, নতুন করে বেঁচে ওঠার গল্প।

 

ঘেরপাড়ের জীবন: পরিশ্রম আর লড়াই শ্যামনগরের নদীপাড়ের ঘেরগুলোতে ঢুকলেই বোঝা যায়—কতটা কষ্টসাধ্য এই পেশা। কাদামাখা খাঁচা হাতে রবিউল ইসলাম কাজ করতে করতে বললেন, ‘সকাল ৭টায় কাজ শুরু করি। সকাল, দুপুর, বিকেল আর সন্ধ্যায় চারবার খাঁচা পরীক্ষা করতে হয়। রাত ১১টা আর ভোর ৩টায়ও ঘুম ভাঙেÑ দেখতে হয় কাঁকড়া খোলস বদলেছে কি না। সফটশেল কাঁকড়া আলাদা করে কোম্পানির লোকজনের হাতে তুলে দিই।’

স্থানীয় চাষীরা প্রতিদিন বাজার থেকে ছোট কাঁকড়া কিনে প্লাস্টিকের খাঁচায় রাখেন। খাবার হিসেবে প্রতিটি খাঁচায় দেওয়া হয় একটি ছোট তেলাপিয়া মাছ। দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই কাঁকড়া খোলস পাল্টায়, ওজন বেড়ে যায় প্রায় ৮০ শতাংশ। এরপর প্যাকেটজাত হয়ে চলে যায় রপ্তানির পথে।

শ্যামনগরের কাঁকড়া ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম জানালেন, ‘কাঁকড়া অল্প জায়গায় অনেক বেশি চাষ করা যায়। যত্ন নিলে লাভও ভালো। খোলস বদলের চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা প্যাকেটজাত করে ঢাকায় পাঠাই। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীন আর জাপানে যায়।’

নারীর হাতে কাঁকড়ার খাঁচা কাঁকড়া চাষে নারীর অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। ঘেরপাড়ের নারীরা খাঁচা পরিষ্কার থেকে শুরু করে কাঁকড়ার খাওয়ানো—সব কাজে যুক্ত। স্থানীয় বাসিন্দা রাবেয়া খাতুন বলেন, :আগে ঘরের কাজ করতাম। এখন নিজের উপার্জন হয়। মেয়েদের পক্ষে এটা ভালো কাজ।’

স্থানীয়রা বলছেন, ‘কাঁকড়া চাষের জন্য এখন গ্রামের অনেক নারী পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আয়ও হচ্ছে ভালো। এটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ।’

কাঁকড়া বনাম চিংড়ি: লাভ কোথায় বেশি? চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়া বেশি লাভজনকÑ এ কথা বলছেন মৎস্যজীবীরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ভাইরাসের প্রকোপ কম, উৎপাদন খরচ কম, পানি ও জমির চাহিদা কম আর পরিপক্বতা অর্জন হয় দ্রুত। বর্তমানে সাতক্ষীরার উৎপাদিত কাঁকড়ার চাহিদা বিশেষভাবে রয়েছে চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং ও থাইল্যান্ডে।

চ্যালেঞ্জ: আশার আড়ালে বাস্তবতা রেনুর ঘাটতি, বনবিভাগের বিধিনিষেধ, হ্যাচারি সংকট আর যাতায়াত সমস্যাÑ এসবই শ্যামনগরের চাষীদের বড় বাধা। চাষী সাইফুল ইসলাম ও রামকৃষ্ণ জোয়ারদার বললেন, ‘মোটাতাজাকরণের খামার যত বাড়ছে, ততই ছোট কাঁকড়ার প্রাপ্যতা কমছে। রেনু না পেলে রপ্তানির বড় সম্ভাবনাও থেমে যাবে।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জি.এম সেলিমের মতে, ‘সরকারি সহায়তা ও পরিকল্পিত কাঠামো ছাড়া এ শিল্প টিকবে না। বিদেশি বাজারের চাহিদা ধরে রাখতে হলে প্যাকেজিং, সংরক্ষণ আর রপ্তানি লাইসেন্সিং সহজ করতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক হ্যাচারি স্থাপন এখন সময়ের দাবি।’

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.