সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের ওপর সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার ছয় দিন পার হলেও মামলার প্রধান আসামিরা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ভিডিও ফুটেজ, ছবি, ভুক্তভোগীদের বয়ান ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থাকলেও প্রশাসনের এই নিষ্ক্রিয়তায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলার সাংবাদিক সমাজ। অবাক করার মতো বিষয় আসামিরা প্রকাশ্যে সাতক্ষীরা থানার সামনেই দলবল নিয়ে ঘোরাফেরা করছে।
এর আগে, গত ৩০ জুন (সোমবার) দুপুরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে চলমান নেতৃত্ব সংকট ও অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা চালানো হয় প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি আবুল কাশেম ও তার সঙ্গে থাকা সাংবাদিকদের ওপর। হামলায় কমপক্ষে ৩০ জন সাংবাদিক আহত হন। ঘটনার পরপরই প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলায় হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম উল্লেখ করা হয় আবু নাসের মো. আবু সাঈদ (৪৫)-এর।পাশাপাশি নাম আসে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী আল ইমরান, অমিত ঘোষ বাপ্পা এবং শাকিলা ইসলাম জুঁই–এরও। প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই ছিল হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ।
এদিকে, আল ইমরান ও অমিত ঘোষের বিরুদ্ধে মাদকাসক্তি, প্রতারণা ও ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে সক্রিয় থাকার অভিযোগ পুরোনো। অপরদিকে, শাকিলা ইসলাম জুঁই বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হলেও ঘটনার দিন তাকে হাতে লোহার রড নিয়ে হামলায় অংশ নিতে দেখা গেছে, যার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে।
সাংবাদিকদের অভিযোগ, এতদিনেও মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বরং ঘটনার পরদিন হামলার মূল অভিযুক্ত আবু সাঈদ নিজেই থানায় পাল্টা মামলা করেন, যেখানে তিনি সাতক্ষীরার ৩৭ জন কর্মরত সাংবাদিককে আসামি করেন। সাংবাদিকদের দাবি, এ মামলা মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রকৃত হামলাকারীদের রক্ষার কৌশল মাত্র।
অভিযোগ রয়েছে, আবু সাঈদ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে চলছেন। এক সময় তিনি ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি এবং ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা মুস্তফা লুৎফুল্লাহ-র আর্থিক সহায়তাকারী (ডোনার)।
২০১৯ সালের ৩১ মে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে প্রথমবারের মতো হামলার সময়ও এমপি রবির ছত্রছায়াতেই সাঈদ ক্লাবে প্রবেশ করে ভাঙচুর চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই সময় প্রেসক্লাবের নবনির্মিত হলরুমের নাম পরিবর্তন করে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু মিলনায়তন’ নামকরণ করে একটি ফলকও স্থাপন করেন।
৫ আগস্ট ২০২৪-এর পরবর্তী সময় থেকে সাঈদ ও তার পরিবার সাতক্ষীরার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন দখলে নেয়। বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি– সাঈদের চাচা আব্দুর রউফ, ভোমরা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন– চাচা হাবিবুল ইসলাম হবি (এখানে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে), সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব–সাঈদের নিজ নেতৃত্বে এখনো রয়েছে তার দখলে।
সাংবাদিকদের ভাষ্য, এসব পদ-পদবি ব্যবহার করেই সাঈদ ও তার সহযোগীরা দখল ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। হামলার পরদিন থেকে সাতক্ষীরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় আসামিদের প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। থানার সামনেই দলবল নিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন আসামিরা, অথচ পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. আবুল কাশেম বলেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনার ভিডিও ও স্থিরচিত্রসহ পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ঘটনার ছয়দিন অতিক্রম করেছে, এখনো পর্যন্ত মূল আসামিদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। আসামিরা থানার সামনেই দলবল নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে—এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও প্রশাসনের ব্যর্থতারই বহিঃপ্রকাশ।
তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করি, এই ঘটনায় জড়িত সবাইকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হবে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রশাসনের আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামিনুল হক বলেন, ঘটনাস্থল থেকেই একজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে হামলাকারীরা প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থানার সামনেই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে—এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি জানান, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে (আইও) বিষয়টি জানান, তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে থানার সামনে আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে—এমন কোনও তথ্য এখনো আমার কাছে পৌঁছায়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।