ব্লু কার্বন বলতে সামুদ্রিক ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র যেমন ম্যানগ্রোভ বন, সমুদ্রঘাসের তৃণভূমি (sea grass meadows) এবং লবণাক্ত জলাভূমি (salt marshes) দ্বারা শোষিত, সংরক্ষিত এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকে রাখা কার্বন বোঝানো হয়। এগুলো বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) অপসারণ করে এবং মাটিতে কার্বন জমা করে, যা জলবায়ু পরিবর্তন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ম্যানগ্রোভ বন, সামুদ্রিক আগাছা (sea grass), লবণাক্ত জলাভূমি ও কোরাল রিফ এই কার্বন শোষণে প্রধান ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, ম্যানগ্রোভ বন প্রতি হেক্টরে বছরে ৩-৪ টন কার্বন সংরক্ষণ করতে পারে। সামুদ্রিক আগাছা বনভূমির তুলনায় ৩৫ গুণ বেশি কার্বন শোষণ করে। বিশ্বের উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র প্রতি বছর ৩০০ মিলিয়ন টন CO₂ শোষণ করে। ম্যানগ্রোভ বন, সামুদ্রিক আগাছা ও লবণাক্ত জলাভূমি বায়ুমণ্ডল থেকে CO₂ শোষণ করে এবং এটি মাটির নিচে হাজার বছর ধরে সংরক্ষণ করে।
ব্লু কার্বনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, ভূমির গাছের তুলনায় ব্লু কার্বন ইকোসিস্টেম ১০ গুণ বেশি কার্বন সংরক্ষণ করতে পারে, ম্যানগ্রোভ ও সমুদ্র ঘাস হাজার বছর ধরে কার্বন জমা রাখতে সক্ষম। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও উপকূলীয় ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়ক। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে। মৎস্য ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। স্থানীয় মানুষের জীবিকা নির্বাহে সহায়তা করে (চিংড়ি চাষ, ইকো-ট্যুরিজম)। ব্লু কার্বন ইকোসিস্টেম ভূমি ক্ষয় প্রতিরোধ করে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন বছরে প্রায় ১,০০০ হেক্টর ভূমি সংরক্ষণ করে। ম্যানগ্রোভ বন ঝড়ের গতি ৩০-৫০% কমাতে পারে, জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ প্রতিরোধে বাঁধের চেয়েও কার্যকর।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্লু কার্বনের গুরুত্ব তথা গ্লোবাল ওয়ার্মিং রোধ তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ২৫% কার্বন নির্গমন সমুদ্র শোষণ করে। ব্লু কার্বন বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হলে, এটি সংরক্ষিত কার্বন পুনরায় বায়ুমণ্ডলে চলে আসে।সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ তথা ম্যানগ্রোভ বন উপকূলীয় প্লাবন ৩০-৫০% হ্রাস করতে পারে। বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৩-৫ মিমি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ব্লু কার্বন সংরক্ষণ দ্বারা কমানো সম্ভব। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ম্যানগ্রোভ বন ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ৩০-৫০% কমিয়ে আনতে পারে। সুন্দরবন প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি ডলারের ক্ষয়ক্ষতি কমায়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও সুন্দরবন রক্ষায় ব্লু কার্বনের সম্ভাবনা : সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ব্লু কার্বন অঞ্চল, বাংলাদেশের ৬০% ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে অবস্থিত। এই বন বছরে ৪ মিলিয়ন টন CO₂ শোষণ করতে পারে। সুন্দরবন ৩৫০ প্রজাতির মাছ ও ৩৪০ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থল।সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম উপকূলীয় অঞ্চল ব্লু কার্বন উন্নয়নের জন্য আদর্শ, সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রবাল ও সামুদ্রিক আগাছা সংরক্ষণ করলে ব্লু কার্বন শোষণ বাড়বে। বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার কার্বন ক্রেডিট পেতে পারে। ইকো-ট্যুরিজমের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব।
ব্লু কার্বন সংরক্ষণে বাংলাদেশের জন্য করণীয় ও সুপারিশ হলো সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন,পরিবেশ সংরক্ষণ আইন শক্তিশালী করা। ব্লু কার্বন প্রকল্পে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। ম্যানগ্রোভ পুনঃবনায়ন বৃদ্ধি ১০,০০০ হেক্টর নতুন ম্যানগ্রোভ বন পুনঃস্থাপন করা, স্থানীয় জেলেদের সম্পৃক্ত করা। ব্লু কার্বন গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নয়ন তথা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ব্লু কার্বন গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন, স্যাটেলাইট ও ড্রোন ব্যবহার করে উপকূলীয় পরিবেশ পর্যবেক্ষণ। টেকসই মৎস্য ও চিংড়ি চাষ নীতি প্রণয়ন: পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষের প্রচলন করা, লবণাক্ততা কমিয়ে কৃষি ও বন সংরক্ষণ করা। ব্লু কার্বন বাজার ও কার্বন ক্রেডিট তৈরি : ব্লু কার্বন ক্রেডিট (Blue Carbon Credit) হল এক ধরনের কার্বন ক্রেডিট, যা উপকূলীয় ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের মাধ্যমে কার্বন শোষণ ও সংরক্ষণের ভিত্তিতে তৈরি হয়। এটি মূলত একটি বাজার ব্যবস্থা, যেখানে কোম্পানি, সংস্থা বা দেশ তাদের কার্বন নির্গমন কমানোর পরিবর্তে ব্লু কার্বন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে এবং এর বিনিময়ে কার্বন ক্রেডিট পায়।
আন্তর্জাতিক কার্বন বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সরকারি খাত ও দাতাসংস্থাকে সম্পৃক্ত করা। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ব্লু কার্বন সংরক্ষণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সুন্দরবনসহ অন্যান্য উপকূলীয় ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ করলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার একটি মডেল হয়ে উঠতে পারে। ব্লু কার্বন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও টেকসই বাংলাদেশ নিশ্চিত করা যায়। সুন্দরবন, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনসহ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ব্লু কার্বন প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের মতে, বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্লু কার্বন ক্রেডিট থেকে আয় করতে পারে। নতুন নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ ব্লু কার্বন ক্রেডিট বাজারে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হতে পারে।
লেখক পরিচিতি: জলবায়ু পরিবর্তণ জনিত প্রভাবে প্রভাবিত একজন উপকূলীয় বাসিন্দা ও উন্নয়ন কর্মী