ধারাবাহিকভাবে খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প খাতে বিনিয়োগ কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হয় ১৭৪৭ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয় ১০৪৯ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয় ৯০ কোটি টাকা। এ হিসেবে খুলনায় তিন বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ কমেছে ১৬৫৬ কোটি টাকা।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এ যাবৎকালে মাত্র দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান খুলনায় শিল্প খাতে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে একটি যশোরে বেনাপোলে শ্রীজি গ্যাসেস বিডি লিমিটেড, অন্যটি বাগেরহাটের রামপালে সিডনি জুট মিলস লিমিটেড। এই দুই প্রতিষ্ঠানে গত দুই অর্থবছরে ১০৯ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ হয়।
বিনিয়োগ বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা, আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তি সম্পাদনে অযোগ্যতা ও দেশে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না হওয়ার এর বড় কারণ। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনার পরিচালক প্রণব কুমার রায় বলেন, বিমান বন্দর, পাইপলাইনে গ্যাস ও জমি অধিগ্রহণের জটিলতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট হয় না। এছাড়া চাঁদাবাজি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে বিগত দিনে বিনিয়োগে বড় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন সড়ক, নৌ ও রেল পথসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা দিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। মোংলা বন্দর থেকে ২০-২৫ কিলোমিটারের মধ্যে প্রাকৃতিক নাব্যতা সম্পন্ন আকরাম পয়েন্ট বা শিবসা পয়েন্টে গভীর সমুদ্র বন্দর করা গেলে শুধুমাত্র খুলনা অঞ্চল নয়, সার্ক অঞ্চলের বানিজ্যে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে যথাশীঘ্র সম্ভব দেশীয়-আন্তর্জাতিক সমীক্ষা করে মোংলার কাছাকাছি একটি গভীর সমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। বিশ্লেষকদের মতে, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বানিজ্যিক বাস্তবতা নিরিখে সারা বিশ্বে হাজার হাজার বৃহৎ রপ্তানির শিল্প কারখানা স্থানান্তরের কাজ চলছে। এই সুযোগকে এখনই কাজে লাগাতে হবে। সানসেট, মাইগ্রেটরি ও টেকভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রিগুলো দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার জন্য বিনিয়োগ অবকাঠামো গড়ে তুরতে হবে। এখানে ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠা করা হলে পাঁচ বছরের মধ্যে খুলনা অঞ্চলে দুই মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে।
বিনিয়োগ বিষয়ক বিশ্লেষক পেনিনসুলা কনসোর্টিয়ামের সিইও নাজির শাহিন বলেন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের জন্য পরিকল্পিত অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১১৭ কিলোমিটার দূরে ড্রেজিংনির্ভর ১৮ মিটার নাব্যতার মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর করা হয়েছে। সেখানে মোংলা বন্দর থেকে ২০-২৫ কিমির মধ্যে প্রাকৃতিক নাব্যতাসম্পন্ন গভীর সমুদ্রবন্দর করা গেলে সার্ক অঞ্চলের বাণিজ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
জানা যায়, বিশ্ব ব্যাপি জলবায়ু পরিবর্তনে গেম মেকার হিসেবে সুন্দরবন রক্ষা করার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। খুলনা বিভাগের ভৌগলিক অবস্থান, জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ শিল্প-সংস্কৃতি বিনিয়োগ সম্ভাবনায় কাজে লাগানো যায়। রেল, সড়ক ও নৌ যোগাযোগ এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত দিক থেকেও খুলনা বিভাগ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অগ্রগামী। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরগুনা এই চারটি জেলার সুন্দরবন অঞ্চল নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইকো ট্যুরিজম এলাকা নির্মাণ করা যায়। যা’ বাস্তবায়ন করে এই এলাকায় বিদেশী পর্যটককে আকৃষ্ট করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ সুবিধা সহযোগিতা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ জামান বলেন, ঐতিহ্যবাহি শিল্প কারখানাগুলো আধুনিকীকরণ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক শিল্প নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ইকো ট্যুরিজমসহ বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুললে বিনিয়োগ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে।