নইন আবু নাঈম তালুকদার শরণখোলা থেকেঃ বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা (ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড) পূর্ব সুন্দর বনে লাগাতার সুরক্ষা অভিযানে জীববৈচিত্র্যের প্রাণ ফিরেছে। লবণাক্ত জলাভূমি বা ম্যানগ্রোভ এই বনে কমে এসেছে বনজসম্পদ পাচার, চোরা শিকারি ও বিষ দিয়ে মাছ ধরা জেলেদের দৌরত্ব। শোনা যাচ্ছেনা গুলির শব্দ, বাতাসে নেই বারুদের গন্ধ। সুন্দরবনের ৮০ ভাগ পর্যটকদের দশর্নীয় স্থান করমজল পর্যটন কেন্দ্র এবাই প্রথম তিন মাসের প্রজনন মৌসুমে বন্ধ রাখা হয়েছে।
গত দু’মাস আগে থেকে শুরু হওয়া চলমান এই অভিযানে এখন সুন্দরবনে কোলাহল মুক্ত পরিবেশে বন্যপ্রাণীরা নির্ভয়ে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুমে বনজীবী ও পর্যটকদের জন্য পহেলা জুন থেকে তিন মাসের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ সময়ের পাশাপশি পহেলা মে থেকেই পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চলমান সুরক্ষায় অভিযানে এসেছে এই সাফল্য। লাগাতর অভিযানে গ্রেফতার হচ্ছে বনজসম্পদ পাচারকারী, চোরা শিকারি ও বিষ সন্ত্রাসীরা। উদ্ধার হচ্ছে হরিণ শিকারের ফাঁদ, নৌকাসহ মাছ ধরা জাল, বিষসহ চোরাই বনজসম্পদ।
বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মোংলা এলাকার সুন্দরবন সন্নিহিত লোকালয়ের বনজীবী আনোয়ার হোসেন, সোহরাব শিকদার, বিমল গাইন, এসকেন্দার বয়াতীসহ অনেকে জানান, বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুমে বনজীবী ও পর্যটকদের জন্য পহেলা জুন থেকে তিন মাসের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও এর এক মাস আগে থেকেই সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ কঠোর নজরদারি শুরু করে। বর্তমানে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে চোরা পথে কেউ সুন্দরবনে ঢুকলেই বন বিভাগের হাতে গ্রেফতার হচ্ছেন। আগে বন কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েও ছাড় পাওয়া গেলেও এখন গ্রেফতার করে জেলে জেলে পাঠাচ্ছে।
শরণখোলার আবুল কালাম ও মোংলার সনৎ হালদার জানান, তাদের সুন্দরবন সন্নিহিত এলাকায় আগে সহজেই ৭ থেকে ৮০০ টাকা কেজিতে হরিণের মাংস পাওয়া যেতো। এমনকি দূরের এলাকায় চোরা শিকারিরা হাজার টাকা কেজি দরে হরিণের মাংস ‘হোম ডেলিভারী’তে পৌঁছে দিতো। গত মে মাস থেকে পরিস্থিতি সম্পূর্ন পাল্টে গেছে। গ্রেফতারের ভয়ে এখন অধিকাংশ চোরা শিকারিরা সুন্দরবন থেকে দূরে থাকায় হরিণের মাংস এখন পাওয়া যাচ্ছেনা।
সুন্দরবন নিয়ে গবেষনা করা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়রপারসন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বাংলা টাইমসকে জানান, সুন্দরবন সুরক্ষায় পুর্ব বিভাগের অভিযানে অনেক সাফল্য এসেছে। চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছেনা। লাগাতর অভিযানে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের প্রাণ ফিরে আসছে। দীর্ঘ দিন ধরে বন অপরাধীরা গহীন অরণ্যের মধ্যে হরিণ শিকারের যেসব ফাঁদ পেতে রাখতো তা এখন বন বিভাগের অভিযানে এখন উদ্ধার হচ্ছে। গোটা সুন্দরবন জুড়োই চোরা শিকারি ও বিষ দিয়ে মাছ ধরাসহ সব বন অপরাধের বিরুদ্ধে এমন অভিযান অব্যাহত রাখার দাবি জানান সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়রপারসন।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ জানায়, ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে প্রতি বছর পহেলা জুন থেকে তিন মাস বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুমে এই বনে পর্যটক ও বনজীবীদের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল ও মায়া হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ২৯২ প্রজাতির মাছের প্রজনন নির্বিঘœ করতে বাড়তি নজরদারি করে থাকে বন বিভাগ। এবার প্রজনন মৌসুমের আগেই পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের নতুন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী যোগ দিয়ে বন অপরাধীদের দমনে কোমরকষে মাঠে নামেন। ঘোষণা দেন, বন অপরাধীদের এক কেজি পরিমান জাল ও হরিণ শিকারের ফাঁদের খোঁজ দিলেই দেয়া হবে ২ হাজার টাকা পুরস্কার। নদী খালে স্মার্ট পেট্রোলিংয়ের পাশাপাশি ফরেষ্ট অফিসগুলোর কর্মকর্তাসহ বনরক্ষীদের প্রতিদিনই পায়ে হেঁটে গহীন অরণ্যে ফুট পেট্রোলিংয়ের। প্রতিদিনই এসব স্মার্ট পেট্রোলিং ও ফুট পেট্রোলিংয়ের ফুটেজ তার মোবাইলে পাঠাবার কড়া নির্দেশ দিলে ঘুম হারাম হয়ে যায় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ বনরক্ষীদের। এভাবে গত মে মাস থেকে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ কঠোর নজরদারির মধ্যে চলে আসায় প্রথমে দুইজন চোরা শিকারিকে তিনটি মাথাসহ ৪২ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করে বনরক্ষীরা।
এছাড়াও গত দুই মাসে সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় ৮৬টি সফল অভিযানে গ্রেফতার করা হয় তিনজন চোরা শিকারিসহ খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরা আরো ৩১জন জেলেকে। এসময়ে মধ্যে বন অপরাধীদের হরিণ শিকারে ব্যবহৃত ১২৫ কেজির অধিক ওজনের মালা ফাঁদ ছাড়াও বিভিন্ন প্রকারের আরো ৩ হাজার ৬৯৮টি ফাঁদ। ৫৩টি ট্রলার নৌকাসহ তিন টন ওজনের জাল, বিষ যুক্ত ৩২৫ কেজি মাছ, ১৩টি বোতল ভর্তি বিষ, মাছ ধরার ৫৩২টি চারু, ৪০০টি বর্শি, ১১০ কেজি রশি, ১৩ পিচ সুন্দরী কাঠের বল্লী ও ৪৮টি সুন্দরী গাছের কচা।
সর্বশেষ গত ৩০ জুন সুন্দরবনে হরিণ শিকারের তৎপর পাথরঘাটার নাসির গ্যাংয়ের উপ প্রধান মো. আরিফুল ইসলাম দুলালকে (৫০) হরিণ শিকারের ৩০০টি মালা ফাঁদসহ শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী অভয়ারণ্যের কাছে সুখপাড়া বন এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। এসময়ে তার কাছ থেকে ১টি ছুরি, ১টি করাত, ২০০ গজ পলিথিন, ১১টি প্লাস্টিকের খালি বস্তা, ২টি পালিত ও ১০০ পুট প্লাস্টিকে রশি উদ্ধার করে বন বিভাগ। অভিযান চলমান থাকলেও দূর্গম এই বনে এখনো বন অপরাধ শুন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ড্রোন ব্যবহার করে লাগাতর এসব অভিযানের ফলে নতুন করে সুন্দরবনে নামা ৫াট বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা টিকতে না পেরে সরে গিয়ে পশ্চিম বিভাগের বনে সরে গেছে বলে বন বিভাগ নিশ্চিত করেছে।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বাংলা টাইমসকে জানান, গত পহেলা মে থেকে বন অবরাধীদে গ্রেফতারে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে লাগাতর অভিযান চালানো হচ্ছে। নদী খালে স্মার্ট পেট্রোলিংয়ের পাশাপাশি ফরেষ্ট অফিসগুলোর কর্মকর্তাসহ বনরক্ষীদের প্রতিদিনই পায়ে হেঁটে গহীন অরণ্যে ফুট পেট্রোলিংয়ের। সুন্দরবন সুরক্ষায় ড্রোনের ব্যবহার করা হচ্ছে। সুন্দরবনের ৮০ ভাগ পর্যটকদের দশর্নীয় স্থান করমজল পর্যটন কেন্দ্র এবাই প্রথম তিন মাসের প্রজনন মৌসুমে বন্ধ রাখা হয়েছে। দুর্গম এই বনে বাঘ, কুমিরসহ কিং-কোবরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ থাকায় রাতে অভিযান চালানো যায়না। এরপরও গত দুই মাসে লাগাতন অভিযানে আশাতিত সাফল্য এসেছে। বন অপরাধীরা এখন সুন্দবনে ঢুকতে শতবার ভাবতে হচ্ছে, কখন তাদের গ্রেফতার হতে হয়। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে বন অপরাধ শুন্যের কোটায় নামিয়ে আনা বাস্তব পরিস্থিতিতে সম্ভব নয়। তবে, অনেক কমিয়ে আসা সম্ভব, লাগাতর অভিযানে সেটাই আমরা করছি। এই ভভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান এই বন কর্মকর্তা।