খুলনা: খুলনা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দিন দিন এ সংকট চরমে পর্যায়ে যাচ্ছে। সমুদ্র তীরবর্তী এ জেলায় পানি থৈ থৈ করলেও জুটছেনা খাবার পানি। নলকূপ ও মোটর পাম্প দিয়ে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজারো বাসিন্দা দুর্ভোগে পড়েছেন। ওয়াসার পাইপলাইনের পানি থাকলেও তা পানযোগ্য নয়, ফলে অনেককে খাবার পানির জন্য অন্যের বাড়িতে যেতে হচ্ছে।
নগরীর বসুপাড়া এলাকার মোঃ কাউছার গাজী বলেন, “নিজের বাড়িতে নলকূপ ও মোটর থাকা সত্ত্বেও পানি পাচ্ছি না। প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে পানি আনতে হয়, যা খুবই লজ্জার।”
শুধু বসুপাড়া নয়, গোবরচাকা, বড় মির্জাপুর, ছোট মির্জাপুর, বাইতিপাড়া ও টুটপাড়া এলাকাতেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার বেশির ভাগ নলকূপ শুকিয়ে গেছে, গভীর নলকূপ থেকেও পানি উঠছে কম।
নগরীর টিবি বাউন্ডারি রোডে মডার্ন টাওয়ারের সামনে এবং ওই রোডের কয়েটটি সাব মার্সেবল পাম্পে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে প্রায় ৬০-৭০ জন লোক বিনামূল্যে পানি নিতে আসেন। কিন্তু ওই সব এলাকার পাম্প চালকরা বলছেন, আমরা সকাল ও বিকেলে সাবমার্সিবল পাম্প চালিয়ে পানি দিই, কারণ আশপাশের অনেকেরই পানির উৎস নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত পানি উত্তোলন ও অপরিকল্পিত নলকূপ স্থাপনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী জানান, নগরীর জলাশয় কমে যাওয়া, বৃষ্টিপাত কম হওয়া এবং ভূগর্ভস্থ পানি পুনরায় মাটির নিচে না যাওয়ার ফলে প্রতি বছর সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) খুলনায় প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভূগর্ভ থেকে ৪২টি পাম্পের মাধ্যমে প্রতিদিন ২ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এর বাইরে, নগরবাসী ব্যক্তিগত ১৪ হাজার নলকূপ ও সাধারণ পাম্প দিয়ে ৩ কোটি লিটার পানি তুলছেন। ফলে ভূগর্ভস্থ স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে।
২০১৯ সালে মধুমতী নদী থেকে ১১ কোটি লিটার পানি পরিশোধন করে সরবরাহের জন্য একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, যার ব্যয় হয়েছিল ২,৫৫৮ কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে সেই প্রকল্প থেকে প্রতিদিন মাত্র ৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মো. রেজাউল ইসলাম জানান, ভূগর্ভ থেকে ১ হাজার লিটার পানি তুলতে ১১ টাকা ব্যয় হয়, আর নদীর পানি পরিশোধন করে সরবরাহে ব্যয় হয় ১৮ টাকা। গ্রাহকের কাছ থেকে ৯ টাকা নেওয়া হয় বলে ব্যয় কমাতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করা হয়নি।
তিনি আরও জানান, নগরীতে ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা ৬২ হাজার। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ পরিবারে পানির যোগান দিচ্ছি। অন্যদিকে খুলনা নগরীতে প্রায় ৩০ হাজার সাবমার্সেবল পাম্প বসিয়েছে বাড়ির মালিকেরা। যা সংকট আরও বাড়াচ্ছে। এছাড়া রয়েছে ৮ হাজারেরও বেশি টিউবওয়েল। বছরের এই সময়টাতে খুলনা ওয়াসার পানিতে কিছুটা লবণাক্ততা বাড়ে। ফলে আমরা এই সময়ে মধুমতির পানির সাথে ভূগর্ভস্থ পানি মিশিয়ে লবণাক্ততা কমিয়ে থাকি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানি পুনরুদ্ধারের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও জলাশয় রক্ষা করা জরুরি। পাশাপাশি, শহরজুড়ে গভীর নলকূপ নির্ভরতা কমিয়ে ওয়াসার পরিশোধিত পানি সরবরাহ বাড়ানো দরকার।
নগরবাসীর দীর্ঘমেয়াদি পানির সংকট কাটাতে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অন্যথায় আগামী দিনে খুলনার পানি সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।