দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

জীবাশ্মের দখল থেকে মুক্তির পথ: নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ———বাহলুল আল

8

বিশ্ব জুড়ে জ্বালানি সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণের প্রেক্ষাপটে নবায়নযোগ্য জ্বালানির গুরুত্ব দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পরিবেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে এবং দীর্ঘমেয়াদে তা অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই প্রেক্ষাপটে নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন সৌর, বায়ু, জলবিদ্যুৎ এবং বায়োমাস একটি টেকসই বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশও নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। তবে এ খাতে যথেষ্ট সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে নানা অন্তরায়।

জীবাশ্ম জ্বালানির সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হলো আমদানি নির্ভরতা ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপ, বাংলাদেশ বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় ৯০% জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে তরল জ্বালানির প্রায় সম্পূর্ণটাই আমদানি নির্ভর। ২০২৩ সালে তেল ও গ্যাস আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে সরকারকে প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকা। এই টাকা যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করা যেত, তবে দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি খাতে আত্মনির্ভরতা গড়ে তোলা যেত। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বায়ু দূষণের একটি প্রধান উৎস। বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধুমাত্র পরিবেশ দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপির প্রায় ৩.৫% ক্ষতি হয়। বাংলাদেশ ২০২৩ সালে প্রায় ৯ কোটন মেট্রিক টন CO₂ নিঃসরণ করেছে, যার একটি বিশাল অংশ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে এসেছে। যদিও বৈশ্বিক হিসাবে এটি তুলনামূলকভাবে কম, তবে দেশের নিজস্ব পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা হিসেবে সৌর শক্তি বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪–৬ কিলোওয়াট ঘণ্টা/মি² সৌর বিকিরণ পাওয়া যায়, যা সৌর শক্তির বিশাল সম্ভাবনা নির্দেশ করে। বাস্তব উদাহরণ হিসেবে বলঅ যেত পারে IDCOL ২০০৩ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৬০ লাখ সৌর হোম সিস্টেম স্থাপন করেছে, যার মাধ্যমে ২ কোটি মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০% বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে সৌরশক্তি হবে মূল ভিত্তি। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে (কক্সবাজার, পটুয়াখালী, খুলনা) গড় বায়ুর গতি প্রতি সেকেন্ডে ৫.৫–৭.৫ মিটার, যা বায়ু শক্তি উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। উদাহারণ হিসেবে বলা যেতে পারে কক্সবাজারে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের মাধ্যমে ১.৫ মেগাওয়াটের একটি বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে। গ্রামীণ অঞ্চলে গবাদি পশুর গোবর, কৃষিজ অবশিষ্টাংশ ও গৃহস্থালির বর্জ্য ব্যবহার করে জৈবজ্বালানি উৎপাদনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এখানেও উদাহারণ হিসেবে বলা যায় গ্রামীণ শক্তি এবং IDCOL এর মাধ্যমে ৭০ হাজারের বেশি বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে, যা রান্না ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্তমানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সীমিত। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। তবে ছোট ছোট মাইক্রো-হাইড্রো প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে পাহাড়ি এলাকায় স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির অর্থনৈতিক উপকারিতা দীর্ঘমেয়াদে খরচ সাশ্রয়ী: একবার স্থাপনার খরচ পরিশোধের পর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অত্যন্ত কম। কর্মসংস্থান সৃষ্টি: প্রযুক্তি স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ, গবেষণা ইত্যাদিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। জ্বালানি নিরাপত্তা: স্থানীয়ভাবে উৎপাদনযোগ্য হওয়ায় বৈদেশিক নির্ভরতা কমে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অবদান: কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়ক। নবায়নযোগ্য শক্তির অন্তরায় হিসেবে দেখা যায় প্রাথমিক বিনিয়োগ ব্যয়নবায়নযোগ্য জ্বালানির স্থাপনার খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি। সৌর প্যানেল স্থাপনে প্রতি কিলোওয়াট ১,০০,০০০–১,২০,০০০ টাকা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা কৃষকদের পক্ষে এটি এককভাবে বহন করা কঠিন। প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবস্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষিত প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদের অভাব রয়েছে। ফলে অনেক সময় স্থাপনা ত্রুটিপূর্ণ হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা দেখা দেয়। জমি সংকটবিশেষ করে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বড় খালি জমির প্রয়োজন হয়। কৃষিজমি বা বসতভিটায় এই জমি জোগাড় করা কঠিন। নীতিমালার অস্পষ্টতাবিদ্যমান নীতিমালায় নবায়নযোগ্য শক্তিকে প্রাধান্য দিলেও, বাস্তবায়নে বিলম্ব ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। একাধিক সংস্থা ও মন্ত্রণালয় কাজ করলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকট। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (PPA) জটিলতা বেসরকারি খাত নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে আগ্রহী হলেও PPA চুক্তি করতে দীর্ঘ সময় লাগে ও নানা শর্ত থাকে।

জলবায়ু ও বায়ু দূষণ পরিস্থিতিবিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ কমাতে নবায়নযোগ্য শক্তির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বায়ু দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা। IQAir ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ু দূষণজনিত রোগে বছরে দেশের ১৫–২০% মৃত্যু ঘটে। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে এই স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতিবাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি NDC (Nationally Determined Contributions): ২০৩০ সালের মধ্যে স্বেচ্ছায় ৬.৭৩% এবং আন্তর্জাতিক সহায়তায় অতিরিক্ত ১৫.১২% কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্য। Renewable Energy Policy ২০০৮: ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ১০% নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসবে। পরে এটি ৪০% এ উন্নীত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। Mujib Climate Prosperity Plan (MCPP): নবায়নযোগ্য শক্তিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা।
বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগ : Paris Agreement (২০১৫): বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশ এ চুক্তির সক্রিয় সদস্য। SDG Goal 7: সবার জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও টেকসই জ্বালানি নিশ্চিত করা। IRENA ও IEA সদস্যপদ: নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।

পরিশেষে সুপারিশ হিসেবে বলা যায় প্রাথমিক বিনিয়োগে ভর্তুকি ও সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান, গ্রামীণ অঞ্চলে সৌর প্যানেল স্থাপনে প্রণোদনা, নবায়নযোগ্য শক্তি বিষয়ক কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, স্থানীয়ভাবে প্রযুক্তি তৈরি ও গবেষণায় বিনিয়োগ, একক নীতিমালার অধীনে নবায়নযোগ্য শক্তি বোর্ড গঠন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে সহায়তা ও চুক্তি প্রক্রিয়া সহজীকরণ।
জীবাশ্ম জ্বালানির সীমাবদ্ধতা, অর্থনৈতিক চাপ ও পরিবেশগত বিপর্যয় বিবেচনায় নবায়নযোগ্য শক্তির গুরুত্ব এখন অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশে এই খাতে সম্ভাবনা অপরিসীম, বিশেষ করে সৌর ও বায়ু শক্তির ক্ষেত্রে। তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, নীতি সহায়তা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং আর্থিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। একটি পরিবেশবান্ধব, টেকসই এবং অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নবায়নযোগ্য শক্তির কোনো বিকল্প নেই। এখন সময় এই খাতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার।
—————–লেখক : জলবায়ু বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.