বাংলাদেশ বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম, এবং এর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষত খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায়। বঙ্গোপসাগরের অদূরবর্তী এই এলাকাগুলো আজ জলবায়ুজনিত বিপর্যয়ের সম্মুখীন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা, নদীভাঙন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি যেন এখানকার মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও লবণাক্ততার ভয়াবহতা
সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯), ফণী (২০১৯), আম্পান (২০২০) প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় এই অঞ্চলকে ভেঙে চুরে দিয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (BWDB)-এর তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় অঞ্চলের স্লুইস গেটগুলোর ৬০%-এর বেশি এখন অকার্যকর বা ভেঙে পড়েছে। ফলাফল: লবণাক্ত পানি সহজেই গ্রাম ও কৃষিজমিতে ঢুকে পড়ে, বসতভিটা ও ফসলভূমি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৬০-এর দশকে নির্মিত “Coastal Embankment Project (CEP)” এর আওতায় নির্মিত প্রায় ১৪০টি পোল্ডারের বড় অংশ আজ জরাজীর্ণ। কয়রা, আশাশুনি, দাকোপ, শ্যামনগরসহ অনেক এলাকায় ভেড়িবাঁধ ভেঙে প্রতি বছর জলাবদ্ধতা ও গৃহহীনতার নতুন ইতিহাস লেখা হয়।
কৃষি ও মৎস্য অর্থনীতির পতন : উপকূলীয় অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ কৃষি ও মৎস্য খাত। সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ঘেরে এক সময় চিংড়ি, কাঁকড়া ও মিঠা পানির মাছের উৎপাদন ছিল দেশের অন্যতম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভয়াবহ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে শুধু চিংড়ি উৎপাদন ২০% কমে গেছে। লবণাক্ততা ও ভাইরাস (যেমন White Spot Disease) এর কারণে মাছের ঘেরে মৃত্যু ব্যাপক হারে ঘটছে।
মৎস্যজীবীদের অনেকেই অনুপযুক্ত জমিতে চাষ করছেন, ফলে মাছের প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে এবং কৃষিজমি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রেও একই দুর্দশা, ধান, পাট, তরমুজ ও শাকসবজি চাষ ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত। লবণ সহিষ্ণু ধানের জাত যেমন BRRI dhan 67, 89 ও Binadhan-10 কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহার হলেও, তা এখনও ব্যাপক পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য ও সামাজিক প্রভাব : উপকূলীয় এলাকার অন্যতম সংকট নিরাপদ পানির অভাব। খুলনা ও সাতক্ষীরার অনেক এলাকায় নলকূপের পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। পানিবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া, চর্মরোগ ও জন্ডিস বেড়েছে। স্বাস্থ্যখাতে বাজেট ঘাটতির কারণে নারী ও শিশু স্বাস্থ্য চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে নারী ও কিশোরীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে, কারণ পানি সংগ্রহের দূরত্ব বেড়েছে, স্যানিটেশন সুবিধা দুর্বল, এবং পুষ্টিকর খাবারের অভাব প্রকট। দীর্ঘমেয়াদে এসব সংকট মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও চাপ তৈরি করছে। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) এর তথ্য অনুযায়ী, খুলনা বিভাগের কিছু উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ৪০%-এর ওপরে। জলবায়ু পরিবর্তন এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরও প্রান্তিক করে তুলছে। জীবিকা হারিয়ে অনেকেই শহরে অভিবাসন করতে বাধ্য হচ্ছেন—এই “জলবায়ু অভিবাসন” আগামী দশকে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটকে আরও তীব্র করতে পারে।
অবকাঠামোগত ঘাটতি ও বাজেট দাবি : বাঁধ, স্লুইস গেট ও খাল এই তিনটি পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামোই বর্তমানে দুর্বল, অব্যবস্থাপনার শিকার এবং জনগণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এই বাস্তবতায়, আসন্ন ২০২৫-২৬ বাজেটে নিচের দাবিগুলো তোলা জরুরি:
● স্লুইস গেট ও ভেড়িবাঁধ সংস্কারে বাজেট বৃদ্ধি এবং স্থানীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে “কমিউনিটিভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা” চালু করা।
● লবণ সহিষ্ণু ফসল ও মাছের জাত উন্নয়নে গবেষণা বরাদ্দ।
● ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও মৎস্যজীবীদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ও কম সুদের ঋণ সুবিধা।
● উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোতে জরুরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ফান্ড ও গভীর নলকূপ/পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন।
● নারী স্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য পৃথক বরাদ্দ, বিশেষ করে প্রজনন স্বাস্থ্য, মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ও শিশু পুষ্টি কর্মসূচি।
খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা—এই তিন জেলার ভবিষ্যৎ এখন রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা, বৈজ্ঞানিক উদ্যোগ ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করছে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তবতা—তবে এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে বাজেট ও নীতিতে পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। নয়তো উপকূল শুধু ভাঙবে না, ভেঙে পড়বে মানুষের আশা, অর্থনীতি ও জীবন।