জলবায়ু অভিযোজন আসন্ন বাজেট ও রাষ্ট্র—————বাহলুল আলম
লেখক : একজন উপকূলীয় জলবায়ু বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (IPCC) অনুযায়ী, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় উপকূলীয় অঞ্চলে।
প্রায় ১৯টি জেলা ও প্রায় ৩ কোটি মানুষ উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে, যারা নিয়মিত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা এবং নদীভাঙনের মতো জলবায়ুজনিত দুর্যোগের সম্মুখীন হয়।
এই প্রেক্ষাপটে আসন্ন জাতীয় বাজেটে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু অভিযোজনমূলক কার্যক্রমে সুনির্দিষ্ট, বাস্তবসম্মত ও তথ্যভিত্তিক বরাদ্দ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে প্রতি বছর গড়ে ২-৩টি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। যেমন ২০০৭ সালের সিডর ও ২০২০ সালের আম্পান লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘরবাড়ি, কৃষি জমি ও মাছের ঘের ধ্বংস করে দেয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (BWDB) ও ইউনিসেফের তথ্যমতে, উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ২.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি লবণাক্ততার কারণে আবাদযোগ্যতা হারাচ্ছে। উপরন্তু, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে নদীভাঙনের ফলে প্রতিবছর গড়ে ৫০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কিছু বরাদ্দ রাখলেও তা উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য পর্যাপ্ত নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের Climate Fiscal Framework অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ৩১,০০০ কোটি টাকা জলবায়ু সম্পর্কিত কার্যক্রমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে মাত্র ২৫-৩০% সরাসরি অভিযোজন কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়েছে। আসন্ন বাজেটে এই বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি করে লক্ষ্যভিত্তিক পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। রাষ্ট্রের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো; যেমন – জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ, উপকূলীয় বাঁধ ও স্লুইস গেট মেরামত ও উচ্চতা বৃদ্ধি, নতুন সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ ও পুরানোগুলোর মানোন্নয়ন; বর্ষা ও জোয়ারে জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন; লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহনশীল কৃষি ও মৎস্য খাত উন্নয়ন; লবণসহিষ্ণু ধান, গম, ও সবজির জাত উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ; জৈব লবণ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি প্রবর্তন; মাছ ও কাঁকড়ার লবণসহনশীল জাত চাষে ভর্তুকি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা; প্রাকৃতিক রক্ষাব্যবস্থা সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার; উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ ও সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি সম্প্রসারণ; চরাঞ্চলে পরিবেশবান্ধব বাসস্থান গড়ে তোলা; উপকূলীয় বন বিভাগকে বাজেটের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা; জলবায়ু অভিযোজন তহবিল ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা; স্থানীয় সরকার পর্যায়ে ‘উপকূল অভিযোজন তহবিল’ গঠন; দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বাজেট বরাদ্দ; জলবায়ু বাস্তুচ্যুতদের জন্য স্থায়ী আবাসন ও সামাজিক সুরক্ষা কার্ড চালু; গবেষণা ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার; সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BARI, BRRI, BFRI)–কে অভিযোজন প্রযুক্তি উন্নয়নে বাজেট প্রদান; স্থানীয় তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নয়ণ; ডিজিটাল জলবায়ু মানচিত্র তৈরি করে পরিকল্পনা গ্রহণ। বাংলাদেশ গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড (GCF), অ্যাডাপটেশন ফান্ড, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সহায়তা গ্রহণ করে উপকূলীয় অভিযোজন কার্যক্রমে তহবিল বাড়াতে পারে। বাজেটে এসব তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চল বাংলাদেশের অর্থনীতি, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব এই অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। তাই আসন্ন বাজেটে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরিকল্পিত, অংশগ্রহণমূলক এবং তথ্য-নির্ভর অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। এসব কার্যকর পদক্ষেপই পারে উপকূলীয় জনগণের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষিত করতে এবং বাংলাদেশকে একটি টেকসই ও জলবায়ু সহনশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে।