খুলনার গল্লামারী স্মৃতিসৌধে আজ এক অনন্য দৃশ্য। ফুলে ফুলে ভরে গেছে পুরো স্মৃতিসৌধ এলাকা। আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। বাঙালির ইতিহাসে এই দিনটি গৌরব, আনন্দ এবং ত্যাগের স্মারক। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যোদয় হয়েছিল। সেই বিজয়ের রক্তিম ইতিহাস স্মরণ করতে হাজারো মানুষ ভিড় জমিয়েছে গল্লামারী স্মৃতিসৌধে।
ভোরের আলো ফুটতেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে খুলনার সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত হন। স্মৃতিসৌধের পথে পড়ে লম্বা সারি। এসময় খুলনার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ফুল নিয়ে হাজির হন জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে।
বিজয় দিবসে সূর্যদয়ের সাথে সাথে প্রথমে শ্রদ্ধা জানান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। তাদের সঙ্গে ছিলেন খুলনার জেলা প্রশাসক। এরপর খুলনার বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, কেসিসির কর্মকর্তারা শ্রদ্ধা জানান।
এর আগে বিজয় দিবসের প্রথম প্রত্যুষে নগরীর বয়রাস্থ মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইনে একত্রিশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের শুভ সূচনা করা হয়। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি ভবন ও প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
গল্লামারী স্মৃতিসৌধটি খুলনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষ শহীদ হন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই এলাকায় নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল। তাদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত এই স্মৃতিসৌধটি এখন কেবল স্মৃতির স্থান নয়, এটি একটি প্রেরণার মঞ্চ। এখানে এসে মানুষ স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করে এবং নতুন করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়।
স্মৃতিসৌধে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম বলেন, “আমরা এই দেশটাকে ভালোবাসি। আমাদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। আজ এখানে এসে তরুণ প্রজন্মকে দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। তারা যদি আমাদের ত্যাগের কথা মনে রাখে, তবে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে।”
গল্লামারী স্মৃতিসৌধের পাশে থাকা ছোট্ট এক মেয়ে, তার হাতে একটি ছোট্ট পতাকা। বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছে সে। ছোট্ট মেয়েটি যখন বলল, “আমি শহীদদের জন্য এসেছি,” তখন উপস্থিত সবার চোখ ভিজে উঠল। এমন দৃশ্যগুলোই বিজয় দিবসকে করে তোলে আরও আবেগময়।
বিজয় দিবস উপলক্ষে গল্লামারীতে দিনব্যাপী নানা আয়োজন করা হয়েছে। শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা করা হয়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা নিয়ে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
গল্লামারী স্মৃতিসৌধে আজকের ভিড় শুধু আনুষ্ঠানিকতার অংশ নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের একটি বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও এই দিনটি বাঙালির হৃদয়ে একই রকম আবেগ সৃষ্টি করে। স্মৃতিসৌধের ফুলেল পরিবেশ যেন শহীদদের প্রতি জাতির চিরন্তন ভালোবাসার প্রতীক।
বিজয়ের এই দিনে গল্লামারীর পরিবেশ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা কোনো সহজলভ্য বিষয় নয়। এটি এসেছে রক্তের বিনিময়ে। তাই আমাদের দায়িত্ব, এই স্বাধীনতাকে যথাযথভাবে রক্ষা করা এবং শহীদদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা।
আজকের এই দিনটি শুধু উদযাপনের নয়, দায়িত্ব পালনের শপথ নেওয়ার দিন। গল্লামারী স্মৃতিসৌধ থেকে এই বার্তাই যেন ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে।