দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

খুলনা মহানগরীর পথে পথে পিঠার ম ম গন্ধ

31

মোঃ মোজাহিদুর রহমান: শীতের সন্ধ্যা। প্রকৃতি কুয়াশায় ঢাকা। ঠান্ডা বাতাসে শরীর যেন হিমশিম খাচ্ছে। এই সময়টাতেই নগরীর মোড়ে মোড়ে দেখা যায় ধোঁয়া ওঠা মাটির চুলা। সেখান থেকে ভেসে আসে পিঠার ম ম গন্ধ। খুলনা মহানগরীর শান্তিধাম মোড় এলাকায় জাতিসংঘ শিশু পার্কের পাশেই পিঠার দোকান বসান নুরুল আমিন (নুরু)। তার দোকানের পিঠা খেতে দূরদূরান্ত থেকে ভিড় জমায় পিঠাপ্রেমীরা।

শীতের সন্ধ্যায় খুলনা নগরীর অধিকাংশ মোড় বা জনবসতি এলাকায় মাটির চুলাই পিঠা তৈরির ধুম পড়ে। খুলনা নগরীর এমন কোন মোড় বা জনাকীর্ণ স্থান নেই যেখানে পিঠা তৈরি হচ্ছে না। আর এসব স্থায়ী পিঠার দোকান থেকে পথচারী বা বাসাবাড়ি থেকে আসেন ক্রেতারা। কেউ কেউ সেখানে দাড়িয়ে আবার কেউ বাসায় নিয়ে আয়েশ করে স্বাদ গ্রহন করেন পিঠার। শীতের দিনের সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকে ফুটপাতের এই মৌসুমী ব্যবসা।

নুরুর পিঠা বানানোর এই পেশা একদিন শুরু করেছিলেন তার বাবা। মাটির চুলায় চিতই, ভাপা আর পাকন পিঠার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল তার হাত ধরেই। বাবার মৃত্যুর পর নুরু এবং তার আরো দুই ভাই রুহুল আমিন, আল আমিন আলাদা আলাদা দোকান দিয়ে এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন।

নুরুর দোকানে চারটি মাটির চুলা। প্রতিটি চুলায় প্রতি মিনিটে তিনটি করে চিতই পিঠা তৈরি হয়। প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত চলে পিঠা তৈরির ব্যস্ততা। ছয় ঘণ্টার এই সময়ে নুরু প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কেজি চালের আটার পিঠা তৈরি করেন। প্রতিটি পিঠার দাম মাত্র পাঁচ টাকা। প্রতিদিন ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার পিঠা বিক্রি করেন তিনি।

নুরু একা নন, তার এই কাজে সহায়তা করে আরও দুই যুবক। তারা একসঙ্গে পিঠা বানানো, পরিবেশন এবং দোকানের অন্যান্য কাজ করেন। তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় পিঠার মান আর স্বাদ অক্ষুণ্ন থাকে।
নুরুর পিঠার প্রধান আকর্ষণ শুধু এর স্বাদ নয়, বরং এর সঙ্গে পরিবেশিত সরিষা, ধনিয়াপাতার ভর্তা এবং খেজুরের গুড়। অনেকে সরিষা ভর্তার সঙ্গে খেতে পছন্দ করেন, আবার অনেকে খেজুরের গুড় দিয়ে গরম গরম চিতই পিঠা খেয়ে তৃপ্ত হন।

নুরুর দোকানের পাশে তার অন্য দুই ভাই মাটির চুলা নিয়ে বসেছে। বড়ভাই রুহুল আমিনও চিতই পিঠা তৈরি করেন আর মেজভাই আল আমিন তৈরি করেন ভাপা পিঠা।ফলে এই মোড়ের চারপাশে পিঠার গন্ধে জমে ওঠে আড্ডা। পিঠা খেতে আসেন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ এবং শিশু। কেউ পরিবার নিয়ে, কেউবা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে। তাদের জন্য পিঠা শুধু খাবার নয়, শীতের সন্ধ্যায় উষ্ণতার এক অন্যরকম উপলক্ষ।

নুরু বলেন, “শীত মানেই পিঠা। এই ঐতিহ্য আমরা আমাদের বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। মানুষকে পিঠা খাওয়ানোর আনন্দই আমাদের শক্তি জোগায়।”

প্রতিদিন পিঠা বিক্রি থেকে নুরু প্রায় ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা আয় করেন। এর মধ্যে কাঁচামাল ও কর্মচারীদের খরচ বাদ দিয়ে তিনি তার পরিবারের জন্য একটি ভালো আয়ের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন।

এ এলাকায় পিঠা খেতে আসেন নগরীর কাস্টমঘাট এলাকার মোঃ সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, এই এলাকায় আগে নুরুর বাবা পিঠা বিক্রি করতেন। তাও প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। এখন তার তিন ছেলে পিঠা তৈরি করে। এখানে মার্চ মাস পর্যন্ত পিঠা বিক্রি হয়।

নগরীর বকসি পাড়া এলাকার সুমাইয়া রহমান আখি জানান, এটি খুলনার শীতের এক অনন্য ঐতিহ্যের পরিচায়ক। কুয়াশা ঢাকা সন্ধ্যায় নুরুর দোকানের ধোঁয়া ওঠা চুলাগুলি যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে এক হৃদয়গ্রাহী পরিবেশ তৈরি করে। আর এই সময় এ এলাকায় যেন পিঠার মেলা বসে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.