দৈনিক খুলনা
The news is by your side.

কেশবপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভুয়া সার্টিফিকেট বাণিজ্য

৫৬ ট্রেডের ভুয়া সনদ প্রদান

65

হারুনার রশীদ বুলবুল, কেশবপুর (যশোর):যশোরের কেশবপুরে প্যারামেডিকেল এন্ড টেকনোলজি ফাউন্ডেশনের (পিটিএফ) নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে ডিএমএফ, ডিএমএ ও ডিএমএসসহ ৫৬টি ট্রেডের ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আবুল কালাম আজাদ ইকতিয়ার নামে এক প্রতারক।

এভাবে গত ১০ বছরে প্রায় ৫০ হাজার ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি ৫০ হাজার টাকা।

তবে, পিটিএফের চেয়ারম্যান বলেছেন, এই পর্যন্ত তিনি প্রায় ১১ হাজার ব্যক্তিকে ট্রেনিং দেওয়ার পর তাদের মাঝে ১১ হাজার সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়েছে। এসময় প্রতি জনের ট্রেনিং খরচ বাবদ ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা করে নেয়া হয়েছে।

এইভাবে তিনি দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় আরও প্রায় ১৫০টি শাখা অফিস খুলে সেখানে শাখা পরিচালক নিয়োগ দিয়ে অবৈধ ট্রেনিংয়ের নামে যুবক-যুবতীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে এরই মধ্যে সর্বস্ব হারিয়েছে শতশত বেকার যুবক ও যুবতি।

এই প্রতারক ইতিমধ্যে রংপুর শহরে একইভাবে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে একটি শাখা অফিস খুললে সিভিল সার্জন তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলে তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হন। পরে তাদেরকে রংপুর মেট্রো পলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর কর্তৃপক্ষ জরিমানাসহ ওই কার্যালয়টি বন্ধ করে দেয়।

সংশ্লিষ্ট অফিস এবং ভুক্তভোগী সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে খুলনার জয়েন্ট স্টক (যৌথ মূলধনি কোম্পানি) থেকে প্যারামেডিকেল এন্ড টেকনোলজি ফাউন্ডেশনের (পিটিএফ) নামে প্রাথমিক অনুমতি নিয়ে কেশবপুর শহরের থানার পাশে মাইকেল মোড়ে একটি অফিস খোলে। যার রেজিঃ নম্বর-৪৪৩/২০১৬। এরপর সেখানে পিটিএফের কেন্দ্রীয় হেড অফিসের সাইন -বোর্ড টানিয়ে ডিএমএফ, ডিএমএ, ডিএমএস, ডিএইচ এমসি, ডিএনএ, প্যাথলজি আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, এক্সরেসহ ৫৬টি ট্রেডের সার্টিফিকেট দেয়ার নামে একটি ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়।

পরবর্তিতে পার্শ্ববর্তি মণিরামপুর উপজেলার পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে দ্বিতীয় তলায়, সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা পেট্রোল পাম্পের সামনে, খুলনার ডুমুরিয়া বাজারে জমাদ্দার মার্কেট, যশোরের মুড়লি মোড়ে ও পালবাড়ি বাজারের নতুন খয়েরতলায় হাইস্কুল রোডে, মহেশপুর, বাগেরহাট কচুয়া বাজার, আলমডাঙ্গা বাজার, বাগেরহাটের ফয়লা বাজার ও খুলনার ফুলতলা এবং খুলনার গল্লামারি বাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায় আরও একাধিক অফিস খোলা হয়। সেখানে ৪ মাস থেকে ৩ বছর পর্যন্ত কোর্সের কথা বলে ১০ থেকে ১ মাসের মধ্যে কোর্স শেষ দেখিয়ে ওষুধের দোকানের কর্মচারি, ডাক্তারদের কমপাউন্ডার, বেকার যুবক ও যুবতীদের কাছে এসব সার্টিফিকেট উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে।

এরমধ্যে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টির সার্টিফিকেটের জন্য ৫৪ হাজার টাকা, ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টির সার্টিফিকেটের জন্য ৩৬ হাজার ৫০০ টাকা, ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্টিফিকেটের জন্য ৩৬ হাজার ৯০০, ডিপ্লোমা ইন অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্টিফিকেটের জন্য ২৫ হাজার ৫০০, ডিপ্লোমা ইন নার্সিং ট্রেনিং প্রোগামের জন্য ৪৫ হাজার ৫০০ এবং ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ল্যাবরেটরি টেকনোলজি সার্টিফিকেটের জন্য ৪৫ হাজার ৫০০ টাকাসহ ৫৬টি ট্রেডের জন্য শ্রেণি ভেদে লাইসেন্স প্রতি মোটা অংকের টাকা নেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে হাজার হাজার বেকার যুবক-যুবতী সার্টিফিকেট নিয়ে তারা দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে ডাক্তারি চেম্বার খুলে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন।

সূত্র জানায়, সুচতুর আবুল কালাম আজাদ ইকতিয়ার, প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে বোকা বানাতে তিনি স্থানীয় প্রশাসন এবং বিভিন্ন দপ্তরে তার প্রতিষ্ঠানের প্যাডে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আবেদন করেন। আবেদনটি দাখিল করার পর তার রিসিভ কপি তার অফিসে ফাইল বন্দি করে রেখে তা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। এখানে আগত ব্যক্তিদের এসব রিসিভ কপির সিল স্বাক্ষর দেখিয়ে বলা হয় তার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের অনুমতি রয়েছে। যা সবই প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য বিষয়ে কোন ট্রেনিং বা সার্টিফিকেট প্রদান করতে হলে, স্ব-স্ব-মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের অনুমতি সাপেক্ষে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে, যেমন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন) মহাখালি ঢাকা ১২১২ এর অনুমোদন বাধ্যতামূলক।

কিন্তু আবুল কালাম আজাদ সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কোন অনুমতি না নিয়েই জয়েন্ট স্টকের অনুমতিকে পুজি করে প্রতারণা করে চলেছেন। তার এই প্রতিষ্ঠানে সরকারি কোন নজরদারি না থাকায় তিনি গত ১০ বছরে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন। ইতিমধ্যে তিনি অবৈধ টাকায় কেশবপুর পৌর শহরের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে এবং ব্র্যাক অফিসের দক্ষিণ পাশে দুইটি বাড়ি এবং তালা থানার দলুয়া বাজারে এব একটি মার্কেট নির্মাণসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। প্রতারক ইকতিয়ারের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার তালা থানার দলুয়া গ্রামে। তার নামে কেশবপুর থানায় হত্যা মামলা, নারী নির্যাতনসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, পিটিএফ কার্যালয় থেকে ডিএমএ সার্টিফিকেট নিয়ে কেশবপুর উপজেলা বড়েঙ্গা গ্রামের তহিদুর রহমান খান, বড়েঙ্গা খেয়াঘাট বাজারে চেম্বার খুলে ডাক্তারি করছেন। এছাড়া ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর এলাকার বিমল চক্রবর্তির ছেলে বিশ্বজিৎ চক্রবর্তি ডিএমএফ, বাদুড়িয়া গ্রামের দিপক রায় ডিএমএ সার্টিফিকেট নিয়ে ডাক্তারি করছেন। অপরদিকে, কেশবপুরের মাগুরখালি গ্রামের মোশারফ হোসেন এখান থেকে ভেটেরিনারি সার্টিফিকেট নিয়ে এলাকায় পশু চিকিৎসাসহ পিটিএফ কার্যালয়ে ভেটেরিনারি সার্জন পরিচয় দিয়ে সেখানে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া মাগুরখালি গ্রামের আব্দুর রহমান এখানে টাকা জমা দিয়ে কিছুদিন ট্রেনিং নেওয়ার পর ভুয়া প্রতিষ্ঠান জানতে পেরে তিনি সার্টিফিকেট গ্রহণ করেননি বলে জানান।

এ ব্যাপারে এলাকার ভুক্তভোগীরা গত ৩ জুন কেশবপুরের ওই ভুয়া প্রতিষ্ঠান পিটিএফ বন্ধসহ এর সাথে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য যশোর দুর্নীতি দমন ব্যুরো, যশোর সিভিল সার্জন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছেন। যার কপি সংরক্ষিত।

এ ব্যাপারে এলাকাবাসী প্রতারক আবুল কালাম আজাদ ইকতিয়ারসহ ১৫০টি শাখার পরিচালকের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

পিটিএফের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ ইকতিয়ার বলেন, তিনি ২০১৬ সালে খুলনার যৌথমুলধনী কোম্পানি (জয়েন্ট স্টক) থেকে অনুমতি নিয়ে কেশবপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় শাখা অফিস খুলে এই পর্যন্ত ১০ থেকে ১১ হাজার যুবক-যুবতীকে ট্রেনিং এর মাধ্যমে সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন। তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ট্রেনিং খরচ বাবদ ১৭ হাজার টাকা থেকে ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ স্ব-স্ব অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছে। তবে তিনি অনুমতির কপি দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

কেশবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডাক্তার আলমগীর হোসেন বলেন, পিটিএফ ট্রেনিং এর নামে ডিএমএফ, ডিএমএ, ডিএমএস, ডিএইচ এমসি, ডিএনএ, প্যাথলজি আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এক্সরেসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধিন ৫৬টি ট্রেডের যেসব সার্টিফিকেট প্রদান করছে তা সম্পূর্ণ অবৈধ।

যশোর জেলা সিভিল সার্জন মাসুদ রানা বলেন, ‘কেশবপুরে পিটিএফ নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে স্থাস্থ্য অধিদপ্তরের নামে সার্টিফিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। যার কোন অনুমতি নেই।

প্রতিষ্ঠান টি সোমবার ভ্রাম্যমাণ আদালতে মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় কেশবপুুরে  প্যারামেডিকেল এন্ড টেকনোলজি ফাউন্ডেশনকে (পিটিএফ) ১লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সোমবার  ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রেকসোনা খাতুন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.