মো. মোজাহিদুর রহমান: গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুথান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। এটি শুধু একটি প্রতিবাদ ছিল না। বরং একটি নতুন প্রজন্মের উত্থান। যারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ও একটি ন্যায়সংগত সমাজ গঠনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এই অভ্যুথান আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, দেশের ভবিষ্যত নির্ভর করে আমাদের তরুণ প্রজন্মের চেতনা, শক্তি এবং একতাবদ্ধ সংগ্রাম। আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, তার পথ এই গণঅভ্যুথানের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক সংকট অনেক মানুষকে হতাশ করেছে। কিন্তু ছাত্রদের এই সংগ্রাম নতুন করে আমাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে। তাদের একত্রিত প্রচেষ্টা, সাহস এবং দাবি আমাদের সবার জন্য শিক্ষা। তারা শুধু নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যই নয়, বরং পুরো জাতির কল্যাণের জন্য গর্জে উঠেছিল। একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য তাদের এই সাহসিকতা আমাদের উৎসাহিত করে।
নতুন প্রজন্মের হাতে বাংলাদেশ কিভাবে গড়ে উঠবে, সে বিষয়েও আমাদের আশাবাদী হতে হবে। তারা বর্তমান সংকটগুলো চিহ্নিত করেছে এবং জানিয়ে দিয়েছে যে, পরিবর্তন সম্ভব। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অযথা ক্ষমতার অপব্যবহার, এসবের বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠস্বর আমাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এখন সময় এসেছে, আমরা যদি সঠিকভাবে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করি, তবে বাংলাদেশের উন্নয়ন দ্রুততার সাথে সম্ভব।
তবে এই পরিবর্তন শুধু ছাত্রদের ওপর নির্ভরশীল নয়। সকল জনগণের একত্রিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি দুর্নীতিমুক্ত, মানবিক এবং সমতার ভিত্তিতে গঠিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ যদি নিজেদের দায়িত্ব পালন করে, তবে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন সার্থক হবে।
অন্যদিকে বাঙালির আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি, ভাষা এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে একুশের চেতনা প্রতিফলিত হয়। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে, একুশের চেতনার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের একুশের চেতনায় উদ্ভাসিত হতে হবে। একটি দেশ তখনই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে যখন তার নাগরিকরা আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্বশীল এবং সকল অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রথমত, একুশের চেতনা শুধু একটি দিনের জন্য নয়, এটি একটি চিরন্তন আদর্শ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন যে মহান ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে এসেছে, তা আমাদের জাতীয় চেতনার শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। মাতৃভাষা নিয়ে যে অহংকার আমাদের মধ্যে ছিল, তা আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্রেরণা দিয়েছে। একুশের চেতনায় উদ্ভাসিত হওয়া মানে হচ্ছে, আমাদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে সব ধরনের বৈষম্য, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একযোগে সংগ্রাম করা।
এটি এক অনস্বীকার্য সত্য যে, বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র একুশের চেতনার সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আমাদের সমাজে আজও দুর্নীতি, ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং অসামাজিক কার্যকলাপ রুখে দেওয়া যায়নি। কিন্তু একুশের চেতনা আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা যদি সঠিক পথে চলি, তবে একদিন এই সমস্ত অসঙ্গতিগুলি দূরীভূত হবে।
আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট হলো দুর্নীতি। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ভেদাভেদ, ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থনৈতিক অসাম্য—এসবের বিরুদ্ধে একুশের চেতনা হতে পারে শক্তিশালী হাতিয়ার। আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন কেবল সরকার ও প্রশাসনের সদিচ্ছা নয়, জনগণের সচেতনতা ও একসাথে কাজ করার মানসিকতা। একুশের চেতনা আমাদের শেখায় যে, ভাষা রক্ষা করতে গেলে জীবন দিতে হয়, তাহলে দেশের সুষ্ঠু পরিবেশ ও মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার্থেও আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
অন্যদিকে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য রোধে সরকারের পদক্ষেপ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সামাজিক সচেতনতার ভূমিকা অপরিসীম। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রত্যেকটি মানুষ যদি নিজ নিজ কাজের প্রতি সঠিক দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করে, তবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। শুধু রেশন ও খাদ্য সহায়তা নয়, সুষম বিতরণ, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কৃষিখাতের উন্নয়ন হতে পারে দারিদ্র্য হ্রাসের একমাত্র উপায়।
বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য দেশের বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক দিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উন্নতি অত্যন্ত জরুরি। যখন রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন প্রতিটি মানুষ নিজের অধিকার বুঝে পাবে। একুশের চেতনায় উদ্ভাসিত নতুন বাংলাদেশ গড়তে আমাদের এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে প্রত্যেকটি নাগরিক আইন ও নিয়ম-কানুন মেনে চলবে। এভাবে আমরা একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুশাসিত এবং ন্যায়পরায়ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
তবে একুশের চেতনায় উদ্ভাসিত নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি জনগণের দায়িত্বও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং স্বদেশী শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করা, এসবই একুশের চেতনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া। একুশের চেতনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জাতি হিসেবে আমরা একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল।
একুশের চেতনাকে ধারণ করে, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা অনেক। একুশের চেতনায় আলোকিত প্রজন্ম শুধুমাত্র ভাষার অধিকার বা স্বাধীনতার জন্য নয়, বরং ন্যায়, সত্য, এবং মানবাধিকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে শিখবে। তারা যদি দুর্নীতি, অন্যায়, ক্ষুধা, জুলুম এবং অশান্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল হবে। এই প্রজন্মের মধ্যে যদি একুশের চেতনা লালিত হয়, তবে তারা দেশে একটি সুষ্ঠু, দয়ালু, এবং উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
একুশের চেতনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বাঙালী মাথা নোয়াবার নয়। তাইতো আজকের দিন থেকে আমরা যদি একযোগে কাজ করতে পারি, তবে একদিন এই দেশ গর্বিত ও উন্নত হবে। গণঅভ্যুথানের মধ্য দিয়ে যে নতুন স্বপ্ন দেখা গেছে, তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং ন্যায়বদ্ধ সমাজ হিসেবে বিশ্বের সামনে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হবে।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট)