বর্তমানে দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। সম্প্রতি খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হওয়া এই সংকটের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।
মৌসুমী পণ্যের দাম এমন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার পেছনে প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ, সরবরাহ চেইনের বড় কোনো বিপর্যয় বা বৈশ্বিক বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা নেই। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কেন এই অস্থিরতা? উত্তর খুবই স্পষ্ট—বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
যারা বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বে, তাদের গাফিলতির সুযোগে দীর্ঘদিন ধরেই কিছু ব্যবসায়ী গড়ে তুলেছে একক আধিপত্য। তারা শুধুমাত্র পণ্যের মজুত ও সরবরাহই নিয়ন্ত্রণ করছে না, বরং সময় বুঝে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের পকেট কেটে নিচ্ছে।
সমস্যাটা এখানেই থেমে নেই—এই সিন্ডিকেট গোষ্ঠী শুধু অর্থনৈতিক নয়, তাদের রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়াও। বড় বড় রাজনৈতিক দলের কিছু প্রভাবশালী নেতার ছত্রচ্ছায়ায় তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, এখন আর তারা নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে না—নিজেদের ইচ্ছেমতো বাজার অস্থির করে তোলে।
আগে দেখা যেত, নির্বাচনের সময় বা সরকার পরিবর্তনের আশঙ্কায় এরা কিছুটা থেমে থাকতো। কিন্তু এখন আর তেমন নয়। তারা নিজেদের এতটাই ‘অস্পৃশ্য’ ভাবতে শুরু করেছে যে, কোনো নিয়ন্ত্রণকেই পাত্তা দিচ্ছে না। এবং এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক।
এই সিন্ডিকেট শুধু পেঁয়াজ বা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে না; তারা একাধিক পণ্যের গুদামজাত, আমদানি, পরিবহন এবং খুচরা বাজার পর্যন্ত সব স্তরে প্রভাব বিস্তার করে। ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে তারা শুধু ভোক্তাকে জিম্মি করে না, বরং সরকারকেও এক ধরনের চাপে ফেলে দেয়। জনমনে সরকারের প্রতি অসন্তোষ তৈরি করাই যেন তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারের এখন প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত—এই সিন্ডিকেট চক্রকে দ্রুত চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান, কার্যকর ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শুধু টুকটাক অভিযান বা জরিমানা দিয়ে এদের দৌরাত্ম্য কমানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন গোড়া থেকে উৎখাত করা। অর্থাৎ যারা রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে এসব কার্যকলাপ করছে, তাদের রাজনৈতিক ব্যাকিংও বন্ধ করতে হবে। দলীয় পরিচয় নয়, অপরাধের ভিত্তিতে বিচার করতে হবে।
বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও আধুনিক করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, বাজারে যেসব মনিটরিং টিম পাঠানো হয়, তারা নির্ধারিত কয়েকটি দোকান বা মার্কেট ঘুরে রিপোর্ট জমা দিয়ে চলে আসে। অথচ সিন্ডিকেটের কার্যক্রম চলে এর বাইরেই।
এছাড়া টিসিবিকে আরও সক্রিয় ও বিস্তৃতভাবে কার্যক্রম চালাতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে পারলে অন্তত একটি স্তরের চাপে সিন্ডিকেটের কৌশল ব্যর্থ করা সম্ভব। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমেও বাজার তদারকি বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে বড় পাইকারি বাজারগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে।
ভোক্তাদের পক্ষ থেকেও সচেতনতা ও সংগঠিত হওয়ার সময় এসেছে। ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষ প্রতিক্রিয়া জানায়, বাজার অস্থিরতা ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তেমন সোচ্চার হলে এদের বিরুদ্ধে গণচাপ সৃষ্টি করা সম্ভব।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা দেশের জনগণের পাশে থাকবে, নাকি কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর ছত্রছায়ায় থেকে ক্ষমতা ব্যবহার করবে। যদি তারা সত্যিকার অর্থে জনগণের পাশে দাঁড়াতে চায়, তবে নিজ দলের মধ্যে থাকা ‘সুপার সিন্ডিকেট’ সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে হবে, দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে।
এই মুহূর্তে যদি সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরা না হয়, তবে ভবিষ্যতে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। তখন কেবল বাজার নয়, সমাজের অন্য ক্ষেত্রগুলোতেও তারা বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। ফলে সময় এখনই—এই দানবের দাঁত-নখ ভাঙার।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক ভারসাম্য এবং রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা—সবই নির্ভর করছে বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ওপর। সরকার যদি এই সংকটে দ্রুত, দৃঢ় ও নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে পারে, তাহলে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরবে, সিন্ডিকেটের দাপট কমবে, এবং বাজারে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।
-লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।